পুরুলিয়া অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণ

অযোধ্যা পাহাড়

অযোধ্যা পাহাড় ও সবুজ অরণ্যে ঘেরা জেলা পুরুলিয়া(Purulia)। সুজলা সুফলা এই পুরুলিয়াকে ঘিরে পর্যটন দিনকে দিন বাড়ছে। দিন দু-তিনেকের ছুটি মিললেই অরণ্যের মাঝে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে পারবেন আপনিও। শহুরে কোলাহল, ধুলো ধোঁয়া এড়িয়ে মায়াবী পরিবেশে দিন কয়েক কাটাতে হলে পুরুলিয়াকে বেছে নিতেই পারেন। আজ আমরা অযোধ্যা পাহাড় সম্বন্ধেই বলব। এটি দলমা পাহাড়ের অংশ। আপনি যদি অযোধ্যা পাহাড়ে ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন, তাহলে কলকাতার কাছে এই পাহাড় আপনার কাছে একটি স্মরণীয় ট্রিপ হয়ে থাকবে।

ঘোরার জন্য পুরুলিয়াকে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা চলে প্রথমটি অযোধ্যা পাহাড় যেটি পুরুলিয়া স্টেশন থেকে যেতে হয়। আর দ্বিতীয়টি বড়ন্তি যেটি পোঁছাতে গেলে আপনাকে আসানসোল হয়ে আসতে হবে। দুটি দিকই সমান জনপ্রিয় এবং দুদিকেই অনেক দেখার জায়গা আছে।

পুরুলিয়া অযোধ্যা পাহাড়ে যাওয়ার সেরা সময়ঃ

শীতকাল ও ফাল্গুন মাস পুরুলিয়া ঘোরার আদর্শ সময়। বর্ষায় গেলে পাহাড়ের অন্য অনুভূতি পাবেন ঠিকই, কিন্তু বৃষ্টি আপনার বেড়ানো মাটি করতে পারে।

কীভাবে যাবেন অযোধ্যা পাহাড়ঃ

ট্রেনে

হাওড়া থেকে চক্রধরপুর এক্সপ্রেস ধরলে রাতে ট্রেনে উঠে ভোর বেলা নামতে পারবেন পুরুলিয়া। একই ট্রেনে ফিরতেও পারবেন। ফেরার ট্রেন পুরুলিয়া জংশন থেকে ছাড়ে রাতে। হাওড়ায় আসে ভোর চারটে নাগাদ। এছাড়াও, আছে রূপসী বাংলা সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস-এ ফিরতে হলে পাবেন বিকেলের ট্রেন।

ট্রেনে পুরুলিয়া স্টেশন, সেখান থেকে একটি টোটো ধরে পুরুলিয়া বাস স্ট্যান্ড, সেখান থেকে গাড়ি বুক করে বা বাসে অযোধ্যা পাহাড় ( বাসের ভাড়া ১০০/-) – অথবা – পুরুলিয়া স্টেশন বা সাহেব বাঁধ এরিয়া থেকেও গাড়ি বুক করে সোজা অযোধ্যা পাহাড় যেতে পারেন।

বাসে

ধর্মতলা থেকে প্রতিদিন বেশ কিছু বাস পুরুলিয়া যায়। সেখান থেকেও বাস নিতে পারেন।

গাড়িতে

কলকাতা থেকে গাড়িতে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টায় পুরুলিয়া পৌঁছনো যায়। কলকাতা থেকে গেলে সড়ক পথে দিল্লি রোড ধরে দুর্গাপুর বা আসানসোল হয়ে পৌঁছনো যায় পুরুলিয়া শহরে।

অযোধ্যা পাহাড়ের দর্শনীয় স্থানগুলিঃ

উসুল ডুংরি – Usul Dungri

দিনের শুরুটা উসুল ডুংরি সূর্যোদয় দেখে করা যেতে পারে। অযোধ্যা হিল টপ থেকে মাত্র ৯ কি.মি পথ। টুডুগোড়া, এদেলবেড়া, কারি ঝরনা গ্রাম পার হয়ে উসুল ডুংরি। চূড়ায় সদ্য নির্মিত ওয়াচ টাওয়ার থেকে সূর্যোদয় দেখা, সে এক দারুন অভিজ্ঞতা। চারপাশে পাহাড়ের শ্রেণী ঘিরে আছে। সকালের সোনালী আভায় উদ্ভাসিত হয় চতুর্দিক। সবুজের রাজ্যে সে এক অন্য সকাল। ফেরার পথে শিমূল বেড়া গ্রামে হাতি খুঁটা ধীরি (হাতি বাঁধার পাথর) দেখাও ভাল লাগবে।

বামনী ফলস – Bamni Falls

বাগমুন্ডি নামার পথে রাঙ্গা মোড়ের নেতাজি মূর্তি থেকে কয়েকশ মিটার নামলেই বামনী ফলস পৌঁছে যাবেন। এটি সমগ্র অযোধ্যার হৃদপিণ্ড। সৌন্দর্যের রানী। ছোট ছোট সিড়ি ভেঙ্গে ঝর্ণার কাছে পৌঁছে যাবেন। ঝর্ণার প্রথম ভিউ পাবেন কিছুটা নামার পর। মিষ্টি ঝরনা অনেক উঁচু থেকে নেমে আসছে। এই প্রথম ধাপ পর্যন্ত সকলেই নামতে পারবেন।

আরও শ পাঁচেক ধাপ নামলেই প্রধান ভিউ। গোটা দশেক পাথরের বাধা টপকাতে আরো এক মোহময়ী রূপ দেখবেন এর যেন পুর্ন যৌবনা নৃত্যপটিয়সীর চঞ্চল রূপ। প্রায় ১০০ ফুট উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ছে বামনী ফলস। ছুটে চলেছে তার অনন্ত জলধারা অজানা গন্তব্যে। পাথর খণ্ডে আহত জল কণা মিশছে বাতাসে। তার শীতল স্পর্শে শরীরে চলে আসে এক অদ্ভুত সজীবতা। দু হাত বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করা যায়। ঝর্ণা র জলে স্নান করার লোভ সামলাতে না পারলে নেমে পড়ুন। নিমেষে মুছে যাবে সমস্ত ক্লান্তি ও মনের গ্লানি।

মার্বেল লেক – Marble Lake Purulia

বাগমুন্ডি আসার পথে রাঙ্গা মোড় থেকে ডানদিকে ৫০০ মিটার দুরেই মার্বেল লেক। পাহাড়ের কঠিন শিলা খনন করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। মার্বেল লেক খয়েরী রঙের পাহাড় এবং পুরুলিয়ার দেহাতি আকর্ষণের মধ্যে একটি দুর্দান্ত গন্তব্য। এই রত্নটি একটি উপজাতীয় অঞ্চলে অবস্থিত যা শাল বনে সুসজ্জিত এবং লাল মাটির সাথে একটি অপরূপ বৈসাদৃশ্য তৈরি করে। খাদে জমা জল সৌন্দর্য্যে অতুলনীয়।কাছে গেলে মনে হয় এই বিশাল সৃষ্টির মাঝে আমরা কত ছোট। একটু শব্দ করুন প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে জল ঘন নীল দেখায়। জলের দিকে চেয়ে বেশ সময় কেটে যায়। আপনি হ্রদের ধারে বসতে পারেন, নুড়িপাথরের উপর হাঁটতে পারেন বা আপনার প্রিয়জনদের সাথে অসংখ্য ছবি অথবা সেলফি তুলতে পারেন।

ময়ূর পাহাড় – Mayur Pahar

সমগ্র অযোধ্যার ভিউ নেওয়ার জন্য একটু হেঁটে ময়ূর পাহাড়ের চূড়ায় আসুন। চারপাশে সবুজের শ্রেণি আপনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবে।পাহাড়ের চারপাশে ঘুরে ঘুরে অপূর্ব ভিউ নেওয়া যায়। চূড়ায় বসে সূর্যাস্তের সাক্ষী হওয়া যায়। এই পাহাড়ে পৌঁছানোর পথ গন্তব্যের চেয়েও বেশী রোমাঞ্চকর। একে বেঁকে চলে যাওয়া রাস্তা, ছোট গ্রাম এবং পথের ধারে সবুজ ধানক্ষেত আপনার ভ্রমণকে আনন্দকর ও রোমাঞ্চকর করে তোলে। তাই অনেকেই এই অযোধ্যা পাহাড় বা নিকটবর্তী দেখার জায়গা গুলি মিনি দার্জিলিং বলে থাকে।

তুর্গা ফলস ও বাঁধ – Turga Falls and Dam

তুরগা গ্রাম অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে একটি বিশেষ দেখার মতো জায়গা। গ্রামটি তুরগা জলপ্রপাতের জন্য বিখ্যাত, যা প্রায় ৩০ ফুট লাফিয়ে নামছে যেন আকাশ থেকে ঝরে পড়া সাদা মুক্তার মতো মনে হবে। এটি আদিম সৌন্দর্যের একটি চিহ্ন এবং দূর দেখে মনে হয় যেন এটি পরিষ্কার নীল আকাশ থেকে প্রবাহিত হচ্ছে। এই স্থানটি প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটি অনন্য এবং নির্মল অভিজ্ঞতা প্রদান করে। পাশের পাথরে বসে ভিউ নেওয়া যায়। তুর্গা ঝর্ণার ধারা ধরে নীচে নামলে আরো ভিউ পাওয়া যায়। একটু নেমে এক হাঁটু জল জমে আছে। পাশেই বালুচর। বাচ্চাদের সাথে আনন্দ করে নিতে পারেন। তবে তুর্গার আরো ভিউ গুলো নিতে চাইলে একটু অ্যাডভেঞ্চার করতে হবে।

মুরগুমা বাঁধ – Murguma Dam

অযোধ্যা পাহাড় থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। মুরগুমার বিস্তৃতি অনেকটা জায়গা জুড়ে।গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা পথে পাহাড়ের গা বেয়ে মন যেদিকে চায় চলুন। প্রকৃতির সান্নিধ্য বেশ উপভোগ করা যায়।পাহাড়ের খাঁজে জল ঢুকে সৌন্দর্য্যে অন্য মাত্রা এনে দেয়।রকমারি ফুল ও পাখির ডাকে উপত্যকা জুড়ে এক বিপুল আয়োজন ,সাজো সাজো রব।নামার পথে হেঁটে বাঁদিকে একটা পাথরের চূড়া থেকে অপূর্ব ভিউ পাওয়া যায়। পাড় ধরে হাঁটার সময় শীতল বাতাস মন মেজাজকে ভালো করে দিয়ে যায়।

আপার ড্যাম ও লোয়ার ড্যাম

অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে দেখার আরেকটি বিখ্যাত আকর্ষণ হল উপরের বাঁধ (Upper Dam)। পুরুলিয়ার শুষ্ক অঞ্চলে জলের বেশ অনটন দেখা গেলে এই জলাশয় গুরুত্বপূর্ণ জলের উৎস হয়ে থাকে। এটি একটি বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত একটি হ্রদ ও গঠন করে। লেকের পাশের রাস্তাটি অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে সূর্যাস্তের অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখায়।

নিচের বাঁধটি (Lower Dam) আপার বাঁধের চেয়েও বেশি মনোরম। এটি পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত এবং হ্রদের তীরবর্তি রাস্তাটি শান্ত হ্রদ এবং সবুজ পাহাড়ের গা দিয়ে গেছে। আপনি আপনার ক্যামেরার মাধ্যমে চারিপাশের আশ্চর্যজনক ফটো ক্যাপচার করতে পারেন।

মুখোশ গ্রাম – Charida the Mask Village

আমরা সবাই পুরুলিয়ার ঐতিহ্যবাহী ছৌ নাচের কথা শুনেছেন যাতে রঙিন পোশাক এবং চোখ ধাঁধানো ভারী মুখোশ ব্যবহার করা হয়। এই মুখোশ প্রধানত তৈরি করা হয় চরিদা নামের একটি গ্রামে। এটি অযোধ্যা পাহাড়ের কাছাকাছি অবস্থিত। এখানে তৈরি অনন্য মুখোশের কারণে চরিদাকে প্রায়শই “মুখোশ গ্রাম” বলা হয়। মুখোশগুলি মাটির মতো প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয় এবং প্রাকৃতিক রং দিয়ে আঁকা হয়। এর পর পুঁতি এবং ফিতা দিয়ে সাজানো হয়। এই মুখোস গ্রাম পরিদর্শন করা আপনাকে পুরুলিয়ার মানুষের মূল সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ছৌ নৃত্য শৈলী এবং জীবিকা সম্পর্কে একটি অন্তর্দৃষ্টি দেবে।

আরও পড়ুনঃ ঘুরে দেখুন ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি সহ ১১টি জায়গা

অযোধ্যা পাহাড়ে সরকারি গেস্ট হাউসঃ

  • পুরুলিয়া যুব ছাত্রাবাস (অনলাইন বুক করা যায়)
    ফোন – 03252224742
  • যুবা আবাস পুরুলিয়া
    ফোন – 2248-0626 / 3744/22109206
  • পুরুলিয়া হরিণ উদ্যান
    ফোন – 03252-222604
  • মাঠা বন বাংলো
    বলরামপুর ফরেস্ট গেস্ট হাউস
    ফোন – 03252-222329
  • ডাব্লুবি সিএডিসি গেস্ট হাউজ বুকিং
    গেস্টহাউস গুলি: নীহারিকা, মালাবিকা, মানসী, মালঞ্চা, অনামিকা, বলাকা, বিভাবাড়ি, উপেখিতা।
    ফোন – 033-22377041-43
    সুজয় বাবু 8001934058 এবং গুর বাবু 7501524345
  • কুমারী কানন গেস্ট হাউস
    যোগাযোগ: ডাব্লুবি সিএডিসি, নীলকুঠিডাঙ্গা, পুরুলিয়া।
    ফোন – 03252-225726

পুরুলিয়া অযোধ্যা পাহাড় ম্যাপঃ

অযোধ্যা পাহাড় ম্যাপঃ


Leave a Comment