নেতারহাট ভ্রমণের জন্য একটা আদর্শ হিল স্টেশন বা শৈলাবাস। ঝাড়খণ্ডের লাতেহার জেলায় ৪০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত নেতারহাটের চারিদিকে ছোট ছোট পাহাড় আর তাকে ঘিরে সবুজ বন, নির্মল প্রাকৃতিক ঝর্না আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আপনি যদি শহরের বাসিন্দা হন তবে আপনার মন এখানে আসার পর এক অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে উঠবে। “ছোটনাগপুরের রানী” নামেও খ্যাত এই অপুর্ব সুন্দর জায়গাটির সৌন্দর্য্য উপভোগ করুন এবং সতেজ ও পুনরুজ্জীবিত হয়ে ফিরে আসুন।
অনন্যা নেতারহাট ভ্রমণ
নেতারহাট জায়গাটিকে লোকে কি আর এমনি এমনি বলে ছোটোনাগপুরের “রানি” । শৈলশহরটি শাল, মহুয়া, পলাশ, পাইন ও ইউক্যালিপটাসের জঙ্গলে ঘেরা একটি জায়গা। নেতারহাট এককালে বাঙালিদের কাছে ভ্রমণের জন্য অতন্ত্য প্রিয় জায়গা ছিল। সৌন্দর্যে সে এখন সবাইকে টেক্কা দেয়। ইদানীং কালে, মানে লক-ডাউনের পর পর্যটক আবার আগের মত আসতে শুরু করেছে। প্রকৃতির এক অনাবিল মাদকতা অনুভব করা যায় নেতারহাট ভ্রমণ করার সময়। তাই অনেকে নেতারহাটকে নেচারহাটও বলে থাকে। বৈচিত্র্য আছে এখানকার প্রকৃতিতে। আর পাঁচটা পাহাড়ি জায়গার মতো হট্টগোল নেই এখানে, শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ। নেতারহাট ভ্রমণ আপনার ছোট্ অবকাশ যাপনের আদর্শ স্থান। নামে নেতারহাট বা ঝাড়খন্ড হলেও এর পরিচ্ছন্ন পাহাড়ি রাস্তায় চললে গ্যাংটকের রাস্তা বলে ভুল হতে পারে। মনে হবে যেন ঝাড়খন্ড নয় আমরা সিকিমে চলে এসেছি।
কি কি দেখবেন নেতারহাটে
বেতলা জাতীয় উদ্যান
বেতলা জাতীয় উদ্যানে চিরসবুজ জঙ্গলে ভর্তি শুধু শাল,পিয়াল, বাঁশ ছাড়াও নানা ধরনের অন্যান্য ওষধি গাছগাছড়া যা থেকে ঔষধ তৈরি হয় সবকিছুই এই জঙ্গলে পাওয়া যায়। নেতারহাট ভ্রমণের একটি বড় পাওনা এই বেতলা। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে বেতলা একটি প্রিয় উদ্যান, বিশেষ করে আপনার বাচ্চাদের সাথে দেখার জন্য। সারা বছর এখানে হাতির দলের দেখা মেলে। তবে এপ্রিল, মে বা জুন মাসে প্রচুর অন্যান্য বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে যেমন শ্লথ বেয়ার, প্যানথার, ভাল্লুক, নেকড়ে, শিয়াল, হায়েনা, লঙ্গুর বা হনুমান এই জঙ্গলে প্রচুর রয়েছে। চার শিং-যুক্ত অ্যানটিলোপ, নীলগাই, সজারু, প্যাঙ্গোলিনও দেখা পাওয়া যায়। বহুখ্যাত “কমলদহ” হ্রদে বহু পাখির আনাগোনা সারা বছরই লেগে থাকে।
বেতলায় সম্ভব হলে অবশ্যই করুন জিপ সাফারি এবং হাতি সাফারি। দেখতে ভুলবেননা বেতলা ফোর্ট বা রাজা মেদিনী রায়ের ফোর্ট।
নেতারহাট পাহাড়
নেতারহাট পাহাড় আপনার প্রিয়জনদের নিয়ে একসাথে ঘুরে দেখার পক্ষে দারুন জায়গা। দারুন এই জন্য যে পাহাড়টি খুব উঁচু বা খুব খাড়াই নয় যে সবাই উঠতে পারবেনা। পাহাড়ের চারপাশে ঘিরে ঘন অরণ্য জায়গাটিকে মনোরম করে তুলেছে।
ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট
ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট, এক কথায় বলা যায় নেতারহাট ভ্রমনে এসে কেউই এই জায়গায় সুর্য্যাস্ত না দেখে ফিরে যায় না। আপনার প্রিয়জনের সাথে দেখার জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলির মধ্যে একটি। সন্ধ্যা হবার মুখে পর্যটকরা সূর্যকে সেদিনের মত বিদায় নিতে দেখতে একত্র হন। স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস যে ব্রিটিশ আমলে ম্যাগনোলিয়া নামে এক ইংরেজ স্থানীয় এক কৃষকের প্রেমে পড়েছিলেন। পরবর্তিতে তিনি নাকি এখানকার পাহাড় থেকে লাফিয়ে তিনি নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন। তখন থেকেই এখানাকার একটি জায়গা “ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট” নামে পরিচিত হয়। এখান থেকে সূর্যাস্তের সেরা দৃশ্য দেখা যায়।
সাদনি জলপ্রপাত
সাদনি জলপ্রপাত নেতারহাট থেকে প্রায় ৩৫ কিমি দূরে অবস্থিত। জলপ্রপাতটি একেবারে সাপের মত আঁকাবাঁকা আকৃতির। এখানে জল একেবারে 200 ফুট নিচে পাথরের উপর আছড়ে পড়ে। এই সর্পাকৃতির জলপ্রপাতটিকে ঝাড়খণ্ডের অন্যতম জনপ্রিয় পিকনিক স্পটও বটে। জলপ্রপাতটি টিলা, স্রোত এবং বন দ্বারা বেষ্টিত যা জলপ্রপাতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে। একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য জনশ্রুতি হল ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে, কিছু সক্রিয় হীরার খনি সাদনি জলপ্রবাহের পথেই সক্রিয় ছিল। খনিগুলি থেকে খুব ছোট ছোট হীরা পাওয়া যেত। যদিও বর্তমানে সেগুলি আর নেই।
লোধ জলপ্রপাত
লোধ ফলস যদিও নেতারহাট থেকে প্রায় ৬০ কিমি দূরে অবস্থিত কিন্তু এটা মিস করবেন না । এটি একসময় ব্রিটিশ ‘লাট সাহেবদের’ বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটি নির্বাচিত গন্তব্য ছিল। লাট বাংলোর ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে। এটি ঝাড়খণ্ডের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত, নেতারহাট ভ্রমণে অবশ্য দ্রষ্টব্য। এখানে বুঢ়া নদীর জল, যা স্থানীয়ভাবে বলা হয় প্রায় ৪৬৮ ফুট উচ্চতা থেকে লাফিয়ে পড়ে। এটি পাহাড়ের দুই দিক থেকে পড়ে এবং বেশ জোর আওয়াজ করে পড়ে। বুঢ়া নদী পরে আশেপাশের স্থানীয় পাহাড় থেকে উদ্ভূত বেশ কয়েকটি বন্য নদী দ্বারা যুক্ত হয়েছে।
আপার ঘাঘরি ফলস
আপার ঘাঘরি নেতারহাট থেকে মাত্র ২ কিমি দূরে অবস্থিত। অদ্ভুত একটা শান্ত আর নির্জন জায়গায় পরিস্কার আকাশের দারুন ঝকঝকে লাগবে। নিজের চোখে দেখলে বিশ্বাস করা যায় কেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এই জলপ্রপাত দেখতে। এই মায়াবি দৃশ্যটি নিজে না দেখলে ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর।
কোয়েল ভিউ পয়েন্ট
কোয়েল ভিউপয়েন্ট নেতারহাট থেকে প্রায় 3 কিমি দূরে অবস্থিত। নেতারহাট ভ্রমণকারীদের অবশ্যই আসতে হবে এখানে। আপনি যদি এই স্থানে যান তাহলে কোয়েল নদীর স্বচ্ছ এবং তাঁর চারিদিকের মনমুগ্ধকর দৃশ্য আপনাকে কল্পনা জগতে নিয়ে যাবেই।
সানরাইজ পয়েন্ট
আপনি যদি আপনার ক্যামেরায় টাইম-ল্যাপস ক্যাপচার করতে চান তবে সানরাইজ পয়েন্ট হল তাঁর জন্য এক্কেবারে আদর্শ জায়গা। দিগন্তে দুর্দান্ত সুর্য্যোদয়ের ভিডিও করার সুযোগ বারবার আসে না। বিভিন্ন ভাবে ট্রিক শটগুল একটু রপ্ত করে নিন।
এগুলি ছাড়াও নেতারহাট ভ্রমণের অন্য রকম পাওনা হল এই আপার ঘাঘরি থেকে ট্রেক করে লোয়ার ঘাঘরিতে যাওয়া। পাহাড়ি এই আপার ঘাঘরি ঝরনাটি নেমে এসেছে প্রায় ৩২০ ফিট উঁচু থেকে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, রামভক্ত হনুমান মালভূমি এই এলাকার খুব কাছেই অঞ্জন গ্রামের একটি গুহায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এখানেই নাকি হনুমান ফল ভেবে সূর্যকে খেতে ছুটে গিয়েছিলেন। তবে এসবই জনশ্রুতি।
নেতারহাট দেখার সেরা সময়
নেতারহাট জায়গাটি এমন নয় যে বছরের কোন এক ঋতুতে একেবারে রুক্ষ বা ভ্রমণ অযোগ্য হয়ে ওঠে। নেতারহাট বছরের যে কোনও সময় এই সুন্দর শহরটি দেখার জন্য দারুন। তবে জলবায়ু সবথেকে মনোরম হয় বসন্তে। ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে নেতারহাটে ভ্রমণের পরিকল্পনা করুন।
কী ভাবে যাবেন নেতারহাট
- আকাশ পথে – নিকটতম হল রাঁচি এয়ারপোর্ট ওরফে বিরসা মুন্ডা এয়ারপোর্ট । এখানে নামুন তারপর আপনি একটি প্রাইভেট বাস বা ট্যাক্সি নিয়ে নেতারহাট হিল স্টেশনে পৌঁছতে পারেন যা প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে। দেশের সব জায়গা থেকে ফ্লাইট রাঁচি বিমানবন্দরে পৌঁছায় তাই বিমানে ভ্রমণ বেশ আরামদায়ক, সুবিধাজনক এবং দ্রুতও বটে।
- ট্রেনে – ট্রেনে রাঁচি গিয়ে সেখান থেকে বাসে বা গাড়ি ভাড়া করে নেতারহাট। কলকাতা, দিল্লি ও মুম্বইয়ের সঙ্গে রাঁচি সরাসরি ট্রেনপথে যুক্ত। তবে ভারতের দক্ষিণের রাজ্যগুলি থেকে আসতে হলে হাওড়া, খড়গপুর বা টাটানগরে ট্রেন বদল করে আসতে হবে।
ট্রেনে কলকাতা থেকে রাঁচি আসুন। মোটামুটি এই চারটি ট্রেন হাতের কাছে পাবেন –
ক্রিয়াযোগ এক্সপ্রেস, শতাব্দী এক্সপ্রেস, হাওড়া-রাঁচি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস (ভায়া টাটানগর) এবং হাওড়া-রাঁচি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস (ভায়া আদ্রা) । উল্লেখিত সব ট্রেনগুলির বর্তমান সময় এখানথেকে জেনে নিতে পারেন ।
রাঁচি ষ্টেশন থেকে নেতারহাট, ১৫৪ কিমি। ( Ranchi to Netarhat distance = 154 km) রাঁচি থেকে সরকারি (স্টেশনের কাছেই সরকারি বাসস্ট্যান্ড) বা বেসরকারি বাসে (রাতু রোডে বাসস্ট্যান্ড) বা গাড়িতে যেতে পারেন। গাড়িতে গেলে পথে অবশয়ই দেখে নিন রাতুর রাজবাড়ি।
- সড়কপথে – আপনার ভৌগলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে, আপনি সড়কপথেও নেতারহাট ভ্রমণের কথা বিবেচনা করতে পারেন। সামগ্রিক সড়ক নেটওয়ার্ক যার মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে তা বেশ ভাল্ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং সহজেই ব্যবহার করা যায়। আপনার সুবিধা অনুযায়ী, আপনি সরকারি বাস, ক্যাব বা আপনার ব্যক্তিগত যানবাহনে ভ্রমণ করতে পারেন।
কোথায় থাকবেন নেতারহাট
প্রথমত রাঁচি, নেতারহাট, বেতলাতে রয়েছে ঝাড়খণ্ড পর্যটনের হোটেল। অনলাইন বুকিং দেখুন এখানে। সব জায়গাতেই বেশ কিছু বেসরকারি হোটেল পাবেন। হোটেল বুকিং-এর বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সন্ধান পেয়ে যাবেন। বেতলায় টাইগার প্রজেক্টের ফরেস্ট রেস্ট হাউস আছে। ফরেস্ট রেস্ট হাউসের জন্য যোগাযোগ – ০৬৫৬৭-২২২৬৫০
নেতারহাট বেড়ানোর কিছু টিপস
- বেতলা বা নেতারহাট আসার সবচেয়ে ভালো সময় হলো অক্টোবর থেকে মার্চ মাস।
- রাঁচী থেকে নেতারহাট প্রথমে এলে বেতলা যাবার দিন লোধ জলপ্রপাত দেখা যাবে কোন অতিরিক্ত সময় ব্যয় ব্যাতীত ।
- রাঁচী থেকে বেতলার দূরত্ব ১৮৫কিমি প্রায়, আর বেতলা থেকে নেতার হাটের দূরত্ব ১২০কিমি প্রায়, সেক্ষেত্রে রাঁচী থেকে নেতারহাট ১৫০ কিমি দূরত্ব প্রথম দিনে অতিক্রম করলে শারীরিক দূর্বলতা কম হবে ও সূর্য্যেদয় বা সূর্য্যাস্ত দেখার সুযোগ বেশী থাকবে ।
- বন বিভাগের হোটেলে থাকতে গেলে আগে থেকে বুক করুন, নাহলে বেসরকারি হোটেলে থাকতে হবে ।
- এই বেতলা বা নেতারহাটে এটিএমের সংখ্যা খুব কম আবার এই এটিএম গুলি রবিবার বা সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে এবং সন্ধ্যেবলায় বন্ধ হয়ে যায়, তাই পকেটে পর্যাপ্ত নগদ রাখবেন।
আরও পড়ুনঃ রাঁচি ভ্রমণ – সেরা ১২ টি দর্শনীয় স্থান
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷