পশ্চিম মেদিনীপুরের দর্শনীয় স্থান উন্নয়নে বর্তমানে জেলা পরিষদ যথেষ্ট সচেষ্ট। ভৌগলিক অবস্থান হিসেবে পশ্চিম মেদিনীপুর রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় রয়েছে অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্র। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ বরাবরই ভ্রমণকারীদের আকর্ষন করে এসেছে। আর বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থানও রয়েছে এই জেলায়। এই নিবন্ধে আমরা কেবল সেরা ৬টি জায়গাার বিষয়ে আলোচনা করব।
পশ্চিম মেদিনীপুরের দর্শনীয় স্থান কি কি?
1. গনগনি
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ভ্রমণ মানচিত্রে একটা উজ্জ্বল নাম। ভুপ্রাকৃতিক কারনে নদীর ক্ষয়ের ফলে ল্যাটেরাইটে তৈরি হওয়া সুন্দর প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে পর্যটক আসে গনগনিতে। ক্ষয়িষ্ণু লাল মাটিতে গড়ে উঠেছে একটা ছোটোখাটো ‘ক্যানিয়ন’। শান্ত শিলাবতী নদীর অল্প জলের ধারে এমন আশ্চর্য প্রাকৃতিক ভূ-গঠন পর্যটকদের আকর্ষণ করে বারবার। ভূপ্রাকৃতিক সাদৃশ্যের কারণে গনগনি বাংলার গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন নামেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় গনগনির রূপ হয় স্বর্গিয়। ফটোগ্রাফির জন্য আদর্শ পরিবেশ। নীল আকাশ আর গিরিখাতে লালের নানা রকম শেড সঙ্গে সবুজ ঘাসের কার্পেট, শিলাবতী নদীর জলে গেরুয়া রঙ আর হলুদ বালুতট। একদিনের ছোট্ট ট্রিপে ঘুরে আসার আদর্শ জায়গা এই গনগনি।
কীভাবে যাবেন গনগনি
- ট্রেনে – হাওড়া, শালিমার বা সাঁতরাগাছি থেকে ট্রেনে করে গড়বেতা স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া যায়। গড়বেতার কাছেই গনগনি।
- বাসে – বাসে করে হাওড়া এবং ধর্মতলা থেকে গনগনি আসা যায়।
- গাড়ি – গাড়ি করে আসতে হলে ৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে পাঁশকুড়া, ঘাটাল, চন্দ্রকোনা হয়ে পৌঁছে যান গনগনি।
আশেপাশে আর কি দেখবেন
আশেপাশের সাইটসিইং হিসাবে দেখতে পারেন – কংসাবতী নদী, গোপগড়ের ইকো পার্ক, সর্বমঙ্গলা কালী মন্দির, রাধানাথ সিংহ স্মৃতি মন্দির, রাজা দুর্জন সিংহের রাধাবল্লভ মন্দির। সবই এই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মধ্যে পড়বে।
কোথায় থাকবেন
গনগনির আশেপাশে অনেক হোটেল, রিসর্ট ও ধর্মশালা রয়েছে যেখানে দু-একটা দিন আনন্দে কাটিয়ে দেওয়া যায়।
গনগনি যাবার সেরা সময়
সারা বছরই আসা যায় তবে বর্ষা বা গ্রীষ্মের দাবদাহ এড়িয়ে শীতকাল হল বছরের সেরা সময় এখানে আনন্দ করার।
2. চন্দ্রকোনা
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার চন্দ্রকোনা একটি ৫০০ বছরের বেশি প্রাচীন শহর। এখানে প্রাচীন হিন্দু, বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মের সৌধ ও উপাসনালয়ের চিহ্ন আজও বর্তমান। এখানে চৌহান রাজাদের লালগড়, রামগড় ও রঘুনাথগড় নামে তিনটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ হল রাজা চন্দ্রকেতুর প্রাসাদ।
জনশ্রুতি ১৫১০ সালের জুন মাসে একদিন, শ্রী গুরুনানক দেবজী পুরীতে তাঁর তীর্থযাত্রা পথে এখানে একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। খবর পেয়ে রাজা চন্দ্রকেতু রায় তার সঙ্গে দেখা করতে ছুটে আসেন। গুরু নানক যে স্থানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন সেখানে শ্রী চন্দ্রজী উদাসীন মঠ স্থাপন করেন। পরবর্তিতে এরই কাছে শিখ গুরুদ্বার তৈরি হয়েছে এবং সেখানে শিখদের পবিত্র গ্রন্থ, গ্রন্থ সাহিব সংরক্ষিত আছে। পর্যটকদের কাছে চন্দ্রকোনা বরাবরই এক আকর্ষণীয় স্থান। বিশেষত যারা ঐতিহাসিক স্থান দেখতে ভালবাসেন, তাদের জন্য দক্ষিণবঙ্গের অবশ্য গন্তব্য স্থানগুলির অন্যতম চন্দ্রকোনা।
চন্দ্রকোনা জোড়বাংলা মন্দির – ১৭শ শতাব্দিতে পাথরের তৈরি এখনও অক্ষত একটি মন্দির।
3. রানি শিরোমণি গড়
ব্রিটিশ ভারতে সম্ভবত প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী রানি শিরোমণি। পারাং নদী ঘেরা প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ – গড় তার নামেই “রানি শিরোমণি গড়”। শিরোমণি গড় প্রায় ১০০ বিঘা জমি নিয়ে গঠিত, যা প্রায় ৪ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এটি মেদিনীপুর শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে, কর্নগড়ে অবস্থিত। রানি শিরোমণির নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহের ইতিহাস বহন করে চলেছে এই এলাকা।
কর্ণগড়ে রয়েছে মহামায়ার মন্দির। মহামায়া মন্দির থেকে এলাকাটির দূরত্ব কিলোমিটার দু’য়েক। মাটিতে মিশে গিয়েছে প্রাসাদ। পরিখাটুকু খানিকটা বোঝা যায়। ঝোপজঙ্গলের মাঝে ইট, পাথর পড়ে রয়েছে।
কী ভাবে যাবেন?
হাওড়া থেকে যে কোনও ট্রেনে মেদিনীপুর স্টেশন। স্টেশন থেকে নেমে গাড়ি ভাড়া বা বাস ভাড়া করে ভাদুতলা। সেখান থেকে গাড়ি বা টোটো করে গেলেই কর্ণগড়। মেদিনীপুর শহর থেকে কর্ণগড় যেতে সময় লাগবে প্রায় ২৫ মিনিট।
কোথায় থাকবেন
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের পরিচালনায় এখানে চার ধরণের প্রায় ৯ টি কটেজ রয়েছে। বাঁশ, মাটি, পাথর এবং কংক্রিট- এই চার ধরণের কটেজ রয়েছে। এখানে পিকনিকের ব্যবস্থাও আছে। আছে ক্যাফেটেরিয়া। আর গড়ের বাইরে রয়েছে মনোমুগ্ধকর পারাং নদী।
জেলা পরিষদের কটেজ তাদের ওয়েবসাইট থেকে বুক করতে পারবেন।
4. নাড়াজোল রাজবাড়ী
মেদিনীপুর শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ইতিহাসের বহু ঘটনা, উত্থান পতনের সাক্ষী এই নাড়াজোল রাজবাড়ি। উদয়নারায়ণ ঘোষ নাড়াজোল রাজ প্রতিষ্ঠা করেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী তিনি বর্ধমান রাজার দেওয়ান ছিলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পদধুলিধন্য এই রাজবাড়ি। যাঁরা একটু ঐতিহাসিক জায়গায় ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন তাঁদের জন্য এই নাড়াজোল রাজবাড়ি সেরা জায়গা হয়ে উঠতে পারে।
রাজপরিবারের মোহনলাল খানের আমলই ছিল নাড়াজোলের স্বর্ণযুগ। তাঁর আমলে ৩৬০ বিঘা জায়গা জুড়ে ‘বহির্গড়’ ও ‘অন্তর্গড়’ হিসেবে বিরাট বসতবাড়ি তৈরি হয়। এই রাজবাড়ি পরিদর্শনে আসনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেবী জয়দুর্গার নাটমন্দিরের অলঙ্করণ তাঁর এতটাই মনে ধরে যে, শান্তিনিকেতন আশ্রমের উপাসনা কক্ষটি নির্মাণের সময়ে কারিগরদের তিনি এখানকার শিল্পরীতিকে অনুসরণ করতে বলেছিলেন।
বর্তমানে রাজবাড়ির অনেকটা অংশ এখন দেখাশোনার অভাবে জীর্ণদশায় চলে গিয়েছে। কিন্ত এখনও রাজবাড়ি চত্বরে ঘুরে বেড়ালে সেই সময়ের ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। তেমন ভাবে রাজবাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না এখন। যাঁরা বংশধর রয়েছেন তাঁরা প্রতিবার কিন্তু পুজো করেন মহা ধুমধাম করে। চাইলে দুর্গাপুজোর সময়ও এখানে আসতে পারেন। অসম্ভব সুন্দর জায়গাটি।
দুর্গা পুজোর সময় নাড়াজোল রাজবাড়ির পক্ষ থেকে রাজবাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আপনারা ৯৭৩৩৬ ২১৪৯৫ বা ৭০০৩০ ৬২৬৪৪ নম্বরে যোগাযোগ করে বুকিং করতে পারবেন।
কিভাবে যাবেন
মেদিনীপুর শহর থেকে গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন প্রায় ৪০ কিমি। অথবা হাওড়া থেকে ট্রেনে পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে গাড়ি করে নাড়াজোল যেতে পারেন।।
5. মোগলমারি
পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, মোগলমারি পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ বৌদ্ধবিহার। নালন্দার সমসাময়িক।হিউ-এন-সাং এসেছিলেন এখানে, তিনি তার ‘সি-ইউ-কি’ভ্রমণ বৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন এই বৌদ্ধবিহারের কথা। ন’দফায় এখানে খননকার্য চালায় পুরাতত্ত্ব বিভাগ। মোগলমারির অতীত ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা গেল যে এক সময় মোগলরা এই পথ ‘মাড়িয়ে’যেত। ‘মাড়ি’,অর্থাৎ পথ। সে কারণেই নাকি নাম হয় ‘মোগলমারি’।আবার কারও মতে, তুকারুই নামে এক জায়গায় মোগল-পাঠানদের মধ্যেযুদ্ধ হয়েছিল, তাতে মারা গিয়েছিলেন বহু মোগল সৈন্য, তারপর থেকেই নাম হয় ‘মোগলমারি’।
মোগলমারিতে প্রাপ্ত ক্যাটালগের ভিত্তিতে জানা যায় ন’দফা খননে কী কী মিলেছে। বৌদ্ধমূর্তি, স্ট্যাকো মূর্তি, মাটির নকশা করা পাত্রের পাশাপাশি সে সময় ব্যবহৃত এসেন্স বা আতরের বোতলের নল অংশগুলি উদ্ধার হয়েছে।যেগুলি সত্যিই খুব আকর্ষণীয়।
ভারতীয় পুরাতত্ত্বের ইতিহাসে এটি একমাত্র মহাবিহার যেখানে একই দিনে প্রায় ৯৫টি বৌদ্ধমূর্তি উদ্ধারের নজির রয়েছে। প্রায় ৫৪ রকমের নকশা করা ইট মিলেছে মোগলমারিতে। মিউজিয়মে এসবের একাধিক নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। তবে অযত্নে রক্ষিত।
কিভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে প্রথমে লোকাল কিংবা এক্সপ্রেস ধরে খড়্গপুর।খড়্গপুর স্টেশন থেকে বের হলেই বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে দাঁতনের বাসে চেপে মোগলমারি। খড়্গপুর থেকে মোগলমারি ঘণ্টা দেড়েকের পথ।সরাসরি দাঁতনের বাস না মিললে একটা ব্রেক জার্নি বেলদা অবধি। বেলদা থেকে মোগলমারি।
কোথায় থাকবেন
কাছাকাছি বলতে খড়্গপুর বা বেলদাতে থাকার জায়গা আছে তবে মোগলমারি ঘুরে দিনে দিনে কলকাতায় ফিরে যাওয়া যায়।
6. কুরুম্বীরা দুর্গ
মোগলমারি থেকে যে আপনি কুরুম্বীরা দুর্গের প্রধান দরজায় দাঁড়াবেন দেখবেন মাকড়া পাথরের দুর্গ, বিরাট অংশ জুড়ে। একে দুর্গ বললেও দুর্গ ঠিক নয়। কারণ পরিখা, ওয়াচ টাওয়ারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনও কিছুই নেই এখানে। চারপাশের আকৃতি দিল্লির দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস-এর মতো। আর একপাশে একটি বিরাট ইমারত। মাথায় তিনটি গম্বুজ। এই দুর্গের কোনও লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি।
মিথ হোক কিংবা ইতিহাস, কুরুম্বীরা ফোর্টের স্থাপত্য কিন্তু নজর কাড়বে আপনার। এর স্তম্ভ এবং ভেতরের কিছু নকশা চোখে পড়ার মতো। ঘুরে দেখতে ঘণ্টাখানেক। অনেক মুহূর্ত ক্যামেরবন্দি করে দিনের শেষে ঘরে ফেরার পালা।
কিভাবে যাবেন
হাইওয়ের উপর মোগলমারি বাসস্টপ থেকে বাস ধরে কুকাই যেতে হবে। না হলে বেলদা কিংবা কেশিয়ারির বাস ধরতে হবে।সেখান থেকে কুকাই বা হাজিপুর।মোগলমারি থেকে কুকাই আধঘণ্টার পথ। ভাড়া ১০ টাকা। কুকাই বাসস্টপে মোরামের রাস্তা ধরে ২ কিমি গেলেই গগনেশ্বর। সেখানেই কুরুম্বীরা ফোর্ট। কুকাই বাসস্টপ থেকে কুরুম্বীরা ফোর্ট টোটো ভাড়া ১০টাকা।
কোথায় থাকবেন
খড়্গপুর,পশ্চিম মেদিনীপুর কিংবা বেলদায় থাকার লজ রয়েছে। তবে দিনে দিনে মোগলমারি ও কুরুম্বীরা ফোর্ট দেখে ফিরে যাওয়াই ভাল। আশপাশে প্রত্যন্ত গ্রাম। বাসস্টপে সময় জেনে ঠিক বাসে উঠবেন। নাহলে সমস্যায় পড়তে পারেন। হাইওয়েতে খড়্গপুরগামী বাস সবসময় আর রাস্তাও ভাল।
আরও পড়ুনঃ হুগলী জেলার ভ্রমণযোগ্য ১০ট জায়গা দেখুন
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷