ভ্রমণ দৃষ্টিভঙ্গিতে পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সুন্দর জেলা। পাহাড়, জঙ্গল ও জলাধার ঘেরা পুরুলিয়া বরাবরই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী। তাই পুরুলিয়া জেলার দর্শনীয় স্থান হিসাবে সম্পুর্ন জেলাকেই ভাবা যেতে পারে। জৈন ভগবতী সূত্র অনুসারে, যেখানে 16টি মহাজনপদ বা প্রাচীন রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে, বর্তমানে যে অঞ্চলটি পুরুলিয়া জেলা তা বঙ্গ ‘এর অংশ। প্রাচীনকালে এটি বজ্রভূমি নামেও পরিচিত ছিল। মাঝখানে এটি বিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পুরুলিয়া জেলার দর্শনীয় স্থান কোনগুলি ?
পুরুলিয়ায় ভ্রমণের উপযোগি জায়গা অনেকগুলি যা ভালভাবে ঘুরে দেখতে বেশ কয়েকদিনের প্রয়োজন। খুব কম করে ৩ তিন লাগবে মোটামুটি ঘুরে দেখার জন্য। এই নিবন্ধে পুরুলিয়া জেলার ৭টি জায়গা বেড়াবার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক তথ্য দেওয়া হোল।
1. অযোধ্যা পাহাড়
অযোধ্যা পাহাড় হোল পুরুলিয়া জেলার গর্ব । দার্জিলিং বাদে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কেবল পুরুলিয়াকেই পাহাড়ি শহর বলা যায়। এটি দলমা পাহাড়ের একটি অংশ। ছোটনাগপুর মালভূমির সবচেয়ে নীচু ধাপ । বাগমুন্ডি বা অযোধ্যা পাহাড়ের আশেপাশের অঞ্চলটি আসলে একটি সম্প্রসারিত মালভূমি। অযোধ্যা পাহাড়ের বিস্তার অনেকটা অঞ্চল জুড়ে। অযোধ্যা পাহাড়ের দর্শনীয় স্থান, এ পাহাড়ের সবচেয়ে বড় শৃঙ্গ গোরগাবুরু।
অযোধ্যা পাহাড়ের নামকরণ নিয়ে কথিত আছে, ১৪ বছরের বনবাসের জীবন কাটাতে এসেছিলেন অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র শ্রীরামচন্দ্র, লক্ষ্মণ ও দেবী সীতা। এ পাহাড়েই তাঁরা কিছুদিন ছিলেন। দেবী সীতার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পাতালভেদী বাণ ছুঁড়ে দিয়ে জল বের করেন। স্থানটি সীতাকুণ্ড নামে পরিচিত। বিজ্ঞানের ভাষায় আর্টেজেয় কূপ।
পুরুলিয়ার ঐতিহাসিক অযোধ্যা পাহাড় ঘিরে রয়েছে খয়রাবেড়া বাঁধ, মার্বেল লেক, তুর্গা লেক, মুখোশ তৈরির ছৌ গ্রাম, পাখি পাহাড়, ময়ূর পাহাড়, পার্দি লেক, বামনি ফলস ও জয়চণ্ডী পাহাড়ের মতো ঐতিহাসিক সব জায়গা।
কিভাবে যাবেন অযোধ্যা পাহাড়
- ট্রেনেঃ হাওড়া স্টেশন থেকে হাওড়া-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার অথবা রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনে করে গিয়ে নামুন পুরুলিয়া অথবা বরাভূম স্টেশনে। অযোধ্যা পাহাড়ে যাওয়ার দুটি প্রধান রাস্তা। একটি ঝালদা হয়ে, আরেকটি সিকরাবাদ হয়ে। গাড়ি ভাড়া করে সহজেই যেতে পারবেন।
- বাসেঃ এছাড়া কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে পুরুলিয়া যাওয়ার বাস ছাড়ে।
- সড়কপথেঃ দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে সড়কপথে দুর্গাপুর ব্যারেজ পেরিয়ে বাঁকুড়া হয়ে অযোধ্যা পাহাড়।
এখান থেকে পুরুলিয়া জেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলি যাওয়া তুলনায় সহজ তাই নিচে আর পুনরাবৃতি করা হয়নি।
2. চেলিয়ামা
চেলিয়ামা হল পুরুলিয়া জেলার একটি ঐতিহাসিক স্থান, যেটি রঘুনাথপুর মহকুমার অন্তর্গত একটি গ্রাম। এটির গৌরবময় ইতিহাসের জন্য এই গ্রামটি ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। চেলিয়ামায় নতুন আবিষ্কৃত বেশ কিছু জৈন পুরাকীর্তি পাওয়া গেছে
পুরুলিয়ার সুপরিচিত দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে একটি চেলিয়ামা, যা ইতিহাসের ছাত্র এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা কারণ এর সমৃদ্ধ ইতিহাস। শহরটিতে ১৭ শতকের সমসাময়িক অগ্রগতির অনেক নিদর্শন রয়েছে। টেরাকোটা স্থাপত্যে প্রভাবিত ভাস্কর্যগুলির জন্য এটি বিস্ময়কর স্থান। চেলিয়ামার পার্শবর্তী জঙ্গলের চারপাশে পোড়ামাটির পুতুল ও অন্যান্য নিদর্শন প্রমাণ করে যে শহরটি অতীতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ ছিল।
মন্দিরের পূর্ব দিকের দেয়ালে পৌরাণিক কাহিনী খোদাই করা আছে। একটিতে শুম্ভ-নিশুম্ভ এবং দেবী চণ্ডীর মধ্যে যুদ্ধের কাহিনী চিত্রিত করে। দ্বিতীয়টিতে রাম ও রাবণের যুদ্ধ এবং তৃতীয়টিতে ভগবান কৃষ্ণের রাসলীলা চিত্রিত হয়েছে। এছাড়া বিষ্ণুর দশাবতার, লতা, পাতা, ফুল, ফল, শিকারের দৃশ্য, ঘোড়ার টানা রথও দেওয়ালে খোদাই করা আছে। মন্দিরের ডানদিকের দেয়ালে লিখন থেকে বোঝা যায় যে এটি ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দ নগদ পঞ্চকোটের রাজা বলভদ্র শেখর সিং দেও-এর রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল।
3. দেউলঘাটা
ভারতের সবথেকে পুরোনো যে কয়টি পোড়ামাটির মন্দির এখনও মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে দেউলঘাটা তাদের মধ্যে অন্যতম। পুরুলিয়া শহর থেকে সড়কপথে মাত্র ৩৩ কিমি দূরে কাঁসাই/কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত দেউলঘাটা সাম্প্রতিককালে পর্যটন কেন্দ্র রূপেও পরিচিতি লাভ করেছে।
দেউলঘাটার মন্দির কারা প্রতিষ্ঠা করেছিল এনিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মূর্তির গঠন-কারুকাজ দেখে অনেকে মনে করেন, দশভুজা মূর্তিটি বৌদ্ধ যুগের। দেউলের দরজাগুলিও ত্রিভুজাকৃতি। এই সবই বৌদ্ধ সংস্কৃতির ছাপ। আবার ভিন্নমতে, এসবই জৈন সংস্কৃতির।
এই দেউল অর্থাৎ মন্দিরটি যে ইট দিয়ে তৈরি তা এতটাই নিখুঁত যে মনে হয় যেন এগুলো যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি করা হয়েছিল, বাস্তবে যদিও তেমনটা হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। বর্তমানে যে দুটি ইটের দেউল দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার মধ্যে একটির উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। প্রবেশদ্বারটি সরু ও ত্রিভুজাকৃতি। দু’টি দেউলই উঁচু বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। এটা জৈন প্রত্নস্থল ছিল পরে ব্রাহ্মণদের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
অনুমান, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এখানে। দেউলঘাটায় একদা বেশ কয়েকটি মন্দির নিয়ে যে মন্দির প্রাঙ্গণ গড়ে উঠেছিল, সংরক্ষণের অভাবে কালের গর্ভে সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বর্তমানে টিকে রয়েছে কেবলমাত্র দুটি দেউল, যেগুলির অবস্থাও ভালো নয়।
4. সাহেব বাঁধ
সাহেব বাঁধ পুরুলিয়া শহরের একদম কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্রায় ৫০একর জায়গা জুড়ে একটি বিশাল জলাধার। বাধের পাশে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত সত্যই মনোরম। এই সাহেব বাঁধ ঝিল ঘিরেই রয়েছে সুভাষ উদ্যান, শিশুউদ্যান, শিকারা পয়েন্ট, জেলা বিজ্ঞান কেন্দ্রের মতো দর্শনীয় পর্যটন স্থান। প্রতিবছর শীতেকালে প্রচুর পরিযায়ী পাখি বেলুচিস্তান, সাইবেরিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে উড়ে আসে সাহেব বাঁধে। তাই শীতে পুরুলিয়া গেলে একজোড়া দূরবীন সাথে নিতে ভুলবেন না। এই সাহেব বাঁধ বর্তমানে পুরুলিয়া শহরের প্রধান দ্রষ্টব্য।
সাহেব বাঁধ হল সমগ্র পুরুলিয়া শহরের পানীয় জলের অন্যতম উৎস। হ্যাঁ, এই বিশাল জলাশয় কিন্তু প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট নয়। ১৮৪৩ সালে ব্রিটিশ কর্নেল টিকলি বেশ কিছু কয়েদির শাস্তি স্বরুপ এই জলাশয় খনন কার্য শুরু করেন এবং টানা ৫ বছর চলে খনন।
5. জয়চন্ডী পাহাড়
রঘুনাথপুর শহর থেকে মাত্র ২ কিমি এবং আদ্রা শহর থেকে মাত্র ৪ কিমি দূরে অবস্থিত এই জয়চন্ডী পাহাড়। জয়চন্ডী পাহাড়ের গড় উচ্চতা ১৫৫ মিটার (৫০৯ ফুট)। জয়চন্ডী পাহাড়ের ঢাল খুবই খাড়া সেজন্য এখানে পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও রয়েছে। এই পাহাড়ের উপর অবস্থিত জয়চন্ডী মাতার মন্দির এখানকার এক বড় আকর্ষণ। পাহাড়ের গায়ে প্রায় ৫০০ সিঁড়ি বেয়ে উঠলে পৌছান যাবে পাহাড় চূড়োয় মন্দিরে।
পাহাড়ের উপরে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে, শোনা যায় কাশীপুরের (পঞ্চকোট ) রাজার সৈন্যরা এখান থেকে নজর রাখতেন বহুদূর পর্যন্ত। সিঁড়ি ভেঙে পাহাড় চূড়োয় ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য কিন্তু সেই কষ্ট নিমেষেই দূর হয়ে যায়, যখন আপনি পাহাড়ের উপর থেকে নিচের দিকে চারিপাশে তাকিয়ে দেখবেন। আহা! কি অপরূপ দৃশ্য। চারিদিকে শুধু সবুজ ঘেরা প্রান্তর, একদিকে শহরের ব্যস্ত জীবন ও অন্যদিকে পাহাড়তলীর গ্রামীণ জীবন। জয়চন্ডী পাহাড়ের নিচে রয়েছে ছোটদের জন্য পার্ক। আছে থাকা-খাওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।
6. বড়ন্তি
পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর সাব ডিভিশনের সাঁতুড়ি ব্লকে অবস্থিত বড়ন্তি একটি ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম। সবুজ চাদরে ঢাকা পাহাড় ঘেরা মিষ্টি একটা গ্রাম বড়ন্তি। গ্রামটির আসল নাম অবশ্য রামজীবনপুর। বাড়িগুলির কাঁচা মাটির দেওয়ালে সুন্দর আলপনা আপনার মনকে আকর্ষণ করবেই। তবে টুসু, ভাদু বা বাঁধনা ইত্যাদি পরবগুলির সময় গ্রামজুড়ে বাজে ধামসা-মাদল। সে এক অদ্ভুত তৃপ্তি দায়ক দৃশ্য দেখা যায়। সময় সুযোগ করে এই পরবের সময় একবার ঘুরে দেখবেন বড়ন্তি।
তবে সাধারনত পর্যটকদের বড়ন্তি মানেই বড়ন্তি পাহাড় সঙ্গে বড়ন্তি লেক যেখানে আপনাকে সূর্যাস্ত দেখতেই হবে। বড়ন্তি হাইকার বা ট্রেকারদের কাছেও সমানভাবে প্রিয়। সেই সঙ্গে রঘুনাথপুর সার্কিট ভ্রমণে দেখে নেওয়া যায় জয়চন্ডী পাহাড়, গড়পঞ্চকোট, বড়ন্তি, মাইথন ড্যাম, পাঞ্চেত ড্যাম ইত্যাদি। আর অযোধ্যা সার্কিটে দেখতে পাবেন পাখি পাহাড়, মার্বেল লেক, বামনী ফলস, টুরগা ড্যাম, চড়িদা মুখোশ গ্রাম, খয়েরবেরা ড্যাম, মুরগুমা ড্যাম।
7. কাশীপুর রাজবাড়ী
পুরুলিয়া স্টেশন থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে কাশীপুর রাজবাড়ী পুরুলিয়ার একটি সুপরিচিত ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিস্তম্ভ। এটি পঞ্চকোট প্রাসাদ নামেও পরিচিত। এই রাজবাড়ীর সাথে মাইকেল মধুসুধন দত্তের ইতিহাস জড়িত আছে। কথিত মাইকেল একসময় এই কাশীপুর রাজবাড়ীতে চাকরি করতেন। পঞ্চকোট রাজপরিবার প্রায় ৮০০ বছর ধরে কাশিপুর শাসন করেন। এই রাজবাড়িটি তৈরি করেন মহারাজা নীলমনি সিং দেও । কাশীপুর রাজবাড়ী তৈরী করতে প্রায় ১০ বছর সময় লাগে কারন এই প্রাসাদে কিছু অত্যাশ্চর্য স্থাপত্য নির্মানের জন্য চীন থেকে রাজমিস্ত্রি আনা হয়েছিল।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশথেকে তৈল চিত্র এবং ঝাড়লন্ঠন ইত্যাদি আনা হয়েছিল। পুরুলিয়ার ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোত ভাবে আছে জড়িয়ে রয়েছে এই কাশীপুর রাজবাড়ী। এই রাজবাড়িটি কেবলমাত্র দুর্গাপূজার সময় সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেয়া হয়। ফলে অন্য সময় এখানে গেলে ভেতরে ঢুকতে পারবেন না। জনহিতৈষী রাজা জ্যোতিপ্রসাদ কাশীপুরে একটি ইংরেজি স্কুল এবং একটি দাতব্য হাসপাতাল স্থাপন করেছেন। এছাড়াও পুরুলিয়া লেডি ডাফরিন হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, কুষ্ট আশ্রম, পশুচিকিৎসা হাসপাতাল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে তার অবদান অনস্বীকার্য। তবে জ্যোতিপ্রসাদ সিং দেও আরও খ্যাতি এবং স্বীকৃতি লাভ করেন যখন পরে তার রাজ্যের অধীনে ধানবাদ-আসানসোল এলাকায় ভূগর্ভস্থ এলাকা থেকে কয়লা খনন করা করেন।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷