পশ্চিমবঙ্গের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি প্রায় নির্জন স্বর্গ যা প্রায়শই এর নিকটবর্তি বকখালির জন্য অধরাই থেকে যায়। পশ্চিমবঙ্গ একটি ভু-প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরা সংস্কৃতি সম্পন্ন রাজ্য। এর অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্য দিয়ে ভ্রমণকারীদের বিস্মিত করা কখনও শেষ হয় না। হেনরি দ্বীপে স্বাগতম, এটি বঙ্গোপসাগরের একটি স্বল্প পরিচিত দ্বীপ। চলুন, হেনরি দ্বীপের নির্মল সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে বেড়িয়ে আসি।
হেনরি দ্বীপ কোথায়
সুন্দরবনের দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত ‘হেনরি আইল্যান্ড’ এক কথায় সমুদ্র ও জঙ্গল একত্রে উপভোগ করার জন্য আদর্শ জায়গা। বকখালির নাম যদি শুনে থাকেন তাহলে তার সঙ্গেই চলে আসে হেনরি আইল্যান্ডের নাম। এমনকি বকখালি ঘুরতে গেলেও এই হেনরি আইল্যান্ড টুক করে দেখে নেওয়া যায়।
হেনরি আইল্যান্ড কলকাতা থেকে ১৩০ কিমি। কলকাতা থেকে পৌছুতে লাগবে প্রায় ৪ ঘন্টা। কাছাকাছি রেল স্টেশন হল নামখানা। বকখালি থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
হেনরি দ্বীপে কিভাবে যাবেন
বিভিন্ন উপায়ে আপনি হেনরি দ্বীপে পৌঁছাতে পারেন কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই আপনাকে কলকাতা আসতে হবে এবং সেখান থেকে হেনরি আইল্যান্ড যেতে হবে। তাই আমি আপনাকে কলকাতা থেকে কিভাবে যাবেন সেটার বিভিন্ন দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করব।
- ট্রেনে করে হেনরি দ্বীপে কিভাবে যাবেন: হেনরি আইল্যান্ড যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় শিয়ালদহ থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল বা নামখানা লোকাল ধরে নামখানা স্টেশন নামতে হবে প্রথমে। তারপর সেখান থেকে টোটো বা অটো করে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় বকখালি। তারপর বকখালি থেকেই রিকশায় বা ট্রেকারে চেপে সোজা হেনরি আইল্যান্ড।
আগে (মানে ২০২০ সাল পর্যন্ত) নামখানা স্টেশন থেকে জেটিঘাট পর্যন্ত এসে ভেসেলে করে নদী পার হয়ে হেনরি আইল্যান্ডে পৌঁছাতে হতো। কিন্তু এখন নামখানা থেকে বকখালিকে যুক্ত করেছে হাতানিয়া দোয়ানিয়া ব্রিজ আর সেই কারণেই এখন নামখানা স্টেশনে নেমে অটো বা টোটো করে সহজেই চলে যাওয়া যায় হেনরি আইল্যান্ড। নামখানা স্টেশন থেকে হেনরি দ্বীপ পর্যন্ত টোটো ভাড়া প্রায় ৪০টাকার মত। - বাসে করে কিভাবে হেনরি দ্বীপে যাবেন: আপনি যদি এসপ্ল্যানেড বা ধর্মতলা থেকে ভ্রমণ করেন তবে আপনি ধর্মতলা থেকে বকখালি পর্যন্ত নিয়মিত পরিবহন বাস পেতে পারেন।
ধর্মতলার বকখালিগামী বাস ভোর ৬টা থেকে শুরু করে বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত চলে সাধারণ সময়ে। বিলাসবহুল বাসের ভাড়া কমবেশি চারশো টাকা। যাত্রীরা হাতনিয়া-দোয়ানিয়া ব্রিজ হয়ে টোটো করে বকখালী পৌঁছতে পারেন। একটি দীর্ঘ, সরু রাস্তা যা হেনরি দ্বীপকে কলকাতা বকখালি হাইওয়ের সাথেও সংযুক্ত করে যার নাম বার্নার্ড রোড। - নিজস্ব গাড়ি নিয়ে হেনরি দ্বীপে পৌঁছাবেন কিভাবে : আপনি জোকা টার্মিনাস থেকে ডায়মন্ড হারবার রোড হয়ে অথবা আপনি কাকদ্বীপ নামখানা রুট হয়েও হাতানিয়া দোয়ানিয়া ব্রিজের উপর দিয়ে নদী পার হয়ে সোজা বকখালি হয়ে এখানে পৌঁছে যাওয়া যাবে। হেনরি আইল্যান্ডের প্রবেশদ্বারে দশ টাকা করে প্রবেশমূল্য লাগে যা কিনা বাইক বা গাড়ির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
হেনরি দ্বীপের নিকটতম বিমানবন্দর হল কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা হেনরিস দ্বীপ থেকে ১৫০ কিমি দূরে অবস্থিত।
হেনরি দ্বীপে কোথায় থাকবেন
হেনরি দ্বীপে থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল ও রিসর্ট রয়েছে তার যেকোন একটি দেখতে পারেন। নিচে কয়েকটি ভাল রিসর্ট বা হোটেলের নাম দেওয়া হল যেমন – সুন্দরী টুরিস্ট কমপ্লেক্স, সোনারতরি রিসর্ট, বে ভিউ টুরিস্ট লজ ইত্যাদি। বেশ কয়েকটি বাজেট হোটেলও হেনরি দ্বীপে রয়েছে যেগুলি অবশ্যই দেখা যেতে পারে।
সুন্দরী টুরিস্ট কমপ্লেক্স বুকিং করার জন্য রাজ্য মৎস দফতরে যোগাযোগ করতে পারেন। (*)
যেহেতু বকখালি থেকে হেনরি দ্বীপ বেশ কাছে এবং বকখালিতে হোটেলের সংখ্যা অনেক বেশি তাই বকখালিতে বার্গেন করার সুযোগ অনেকটাই বেশি।
হেনরি দ্বীপের ইতিহাস
উনিশ শতকের এক ইউরোপীয় সাহেব হেনরি একটা সময়ে এই অঞ্চলের সার্ভেয়ার ছিলেন। তাঁর নামানুসারেই এই দ্বীপটির নামকরণ করা হয়েছে হেনরি আইল্যান্ড বা হেনরি দ্বীপ।
কি কি দেখবেন হেনরি দ্বীপে
হেনরি আইল্যাণ্ডে গেলে দেখা যাবে ম্যানগ্রোভ অরণ্য, সমুদ্র সৈকত আর পরিযায়ী পাখিদের। এই দ্বীপের যেগুলি আপনার মন ছুয়ে যাবে তা হল।
সুন্দরী সমুদ্র সৈকত
বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দ্বীপ হেনরি দ্বীপ নিরিবিলি শান্ত একটি সমুদ্র সৈকত। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় দ্বীপের সৌন্দর্য দেখার মত, দারুণ উপভোগ্য। জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল সৈকতের একেবারে সামনে চলে আসে। আবার ভাটার সময় সমুদ্র সরে যায় অনেক দূরে। কাচের মতো পরিস্কার সমুদ্রের জলে ঝিনুক, কাঁকড়ারও দেখা মিলতে পারে। তবে অবশ্যই মনে রাখবেন– এখানে সমুদ্রে স্নান করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ – ( কারন দৈবাত বা খুব কম হলেও এখানকার চোরাবালির প্রভাব )। এমনকি সন্ধ্যেবেলায় সমুদ্রের ধারে না থাকার পরামর্শই দেওয়া হয়।
ম্যানগ্রোভ অরণ্য
হেনরি আইল্যান্ড সুন্দরবনেরই একটি বিচ্ছিন্ন অংশ হওয়ায় এখানে বিশাল জায়গা জুড়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া গাছের সমারোহ রয়েছে। কাদা থেকে শ্বাসমূলগুলি জমির উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এই অফুরন্ত সবুজের সমারোহ মনে প্রশান্তি এনে দেয়। ম্যানগ্রোভ অরণ্যে নানা ধরনের পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। শীতকালে এখানে নানা দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা উড়ে আসে। এটি রেড নট, কিংফিশার, কমন স্নাইপ, গ্যাডওয়াল, কাঠঠোকরা এবং হুইসলিং হাঁসের মতো বিদেশী পাখির প্রজনন ক্ষেত্র।
মৎস্য প্রকল্প
এই দ্বীপের খ্যাতির কারণ প্রধানত এখানকার মৎস্য প্রকল্পগুলির জন্য। এখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ৮০টি মাছের ভেড়ি আছে যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি ছাড়াও অন্যান্য মাছের চাষ করা হয়।
ওয়াচ টাওয়ার
দুটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে এখানে যার মধ্যে একটি সুন্দরী রিসর্ট সংলগ্ন এবং এর উচ্চতা ১১৫০ ফুট। এখান থেকে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সবুজের সমারোহ খুব ভালো করে উপভোগ করা যায়। সমস্ত দ্বীপটিকে পাখির নজরে দেখতে হলে ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি।
হেনরি দ্বীপে যা যা করতে পারেন
- সূর্যে বাস্কিং – হেনরি দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ হল এর সৈকত। নরম বালি, মৃদু ঢেউ এবং নির্মল পরিবেশ এটিকে আরাম এবং বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটি উপযুক্ত জায়গা করে তোলে। শ্বাসরুদ্ধকর সূর্যাস্তগুলি মিস করবেন না যা আকাশকে কমলা এবং গোলাপী রঙে রঙ করে দেয়।
- পাখি পর্যবেক্ষন – হেনরি দ্বীপ পাখি পর্যবেক্ষকদের একটি স্বর্গরাজ্য। পরিযায়ী পাখি সহ 90 টিরও বেশি প্রজাতির পাখির সাথে, এটি আবাসিক এবং পরিযায়ী ডানাওয়ালা উভয় বন্ধুদের স্পট করার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা। কিংফিশার, হেরন এবং এমনকি গ্রেট সাদা পেটযুক্ত সমুদ্র ঈগলের জন্য নজর রাখুন।
- এই দ্বীপে মাছ ধরা উপভোগ করুন। সারাদিন যখন ওই মাছ ধরার ছোট পাল তোলা নৌকাগুলি ভেসে বেড়ায় আপনি কল্পনার জগতে ভাসতে থাকবেন।
- চিংড়ি মালাই কারি – ক্রিম এবং হালকা মশলাযুক্ত, এই খাবারটি চিংড়ি প্রেমীদের জন্য স্বর্গিয় আনন্দদায়ক। এটি একটি নারকেল দুধের গ্রেভিতে রান্না করা মালাইকারি আর গরমাগরম ভাত।
- নির্মল দ্বীপে কিছু তাজা ডাবের জল খান আর টেনশন ফ্রি সময় কাটান।
- আপনি জোয়ারের জলও অনুভব করতে পারেন যা দ্বীপগুলিতে একটি দারুন অভিজ্ঞতা ।
- হেনরি দ্বীপে পরিষ্কার নীল আকাশের সাথে ছবি তুলুন যেটা কলকাতায় অলিক কল্পনা।
- দ্বীপের সংকীর্ণ, জলাবদ্ধ পথ ধরে বনের প্রান্ত এবং ট্রেইল এক্সপ্লোর করুন।
জায়গাটি আপনার সপ্তাহান্তে ভ্রমণের একটি আদর্শ গন্তব্য। দ্বীপে সবুজের সমারোহের ফলে একটি প্রানশক্তিতে ভরপুর পরিবেশের মধ্যে সময় কাটাবেন।
হেনরি দ্বীপ যাওয়ার সেরা সময়
বছরের যে কোনো সময় হেনরি দ্বীপ যাওয়া যায়। তবে গরমকাল বাদ দিয়ে গেলেই ভালো।
হেনরি দ্বীপ পরিদর্শনের সর্বোত্তম সময় হল শরৎকাল, শীতকাল এবং বসন্তের শেষ দিকে (অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ)। এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম এবং মৃদু এবং প্রচুর বিদেশী এবং পরিযায়ী পাখি এই দ্বীপে এসে বাসা বাঁধতে দেখা যায়। এই সময়টি মাছ ধরা এবং বোটিং কার্যক্রমের জন্যও সর্বোত্তম। সঙ্গে টাটকা খেজুর গুড় ও সুন্দরবনের মধু উপরি পাওনা।
হেনরি দ্বীপের কাছাকাছি অন্যান্য আকর্ষণ
ফেরার পথে হেনরি দ্বীপ এবং বকখালির কাছাকাছি ফ্রেজারগঞ্জ উইন্ড পার্ক, জম্বু দ্বীপ এবং বিশাল লক্ষ্মী মন্দির ছাড়াও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে যা আপনি ঘুরে দেখতে পারেন। যেমন মৌসুনি দ্বীপ বা সাগরদ্বীপ ইত্যাদি। ইচ্ছা করলেই ঘুরে দেখতে পারেন মৌসুনি দ্বীপ।
সমুদ্র সৈকত, ম্যানগ্রোভ, পাখি এবং দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে বারবার প্রকৃতির প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে।
(*) প্রাইভেট হোটেল সংক্রান্ত ওয়েব সাইটের লিঙ্ক না দেওয়ার কারন যাতে আমরা পক্ষপাত করে না ফেলি।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷
থাকার জায়গার উল্লেখ নেই
কোথায় থাকব এবং কিভাবে বুকিং করতে হবে, জানাবেন।
নিখিল বাবু,
ধন্যবাদ, আপনার মন্তব্যের জন্য।
আমরা থাকার জন্য কয়েকটি হোটেল ও রিসর্টের নাম দিয়েছি এবং কেবল সরকারি ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সে বুকিং লিঙ্ক দিয়েছি।