মালদা জেলার দর্শনীয় স্থান – সেরা ১০টি বেড়াবার জায়গা

মালদা জেলার দর্শনীয় স্থান

মালদা জেলার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক ভ্রমণ পিপাসু বাঙালির কাছে মালদা মানেই প্রথমে গৌড় এবং দ্বিতীয় আদিনা মনে আসে। এই দুই এলাকায় প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দেখার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটক আসেন। পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের এই জেলাটি ইংলিশ বাজার নামে পরিচিত ছিল। মহানন্দা ও কালিন্দী নদীর সঙ্গমস্থলের পূর্ব দিকে অবস্থিত এই জেলাটির উত্তরে রয়েছে পাড়ুয়া এবং দক্ষিণে গৌড়। গৌড় এবং পাণ্ডুয়াকে ঘিরে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক কাহিনী। বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায় এই দুই শহরে।

মালদা জেলার দর্শনীয় স্থান – সেরা ১০টি কোনগুলি


1. দাখিল দরওয়াজা

দাখিল দরওয়াজা

দাখিল দরওয়াজা হল মালদার গৌড় শহরে অবস্থিত একটি মুল্যবান ঐতিহাসিক স্থাপত্য। ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দে দাখিল দরওয়াজা নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সময় গৌড় দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসাবে ব্যবহৃত হত এই দরওয়াজাটি। ইহার অলঙ্করণে কোন রকম প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায় না। এর শীর্ষে চার কোণে রয়েছে পাঁচতলা উঁচু টাওয়ার। দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বারটি ছাড়াও এটি চারপাশের বাঁধের মধ্য দিয়ে খোলে। সমসাময়িক অন্যান্য স্থাপত্যগুলির মতোই পোড়ামাটির শিল্পশৈলীর দ্বারা এই প্রাচীন দাখিল দরওয়াজা অলংকৃত হয়েছিল।

অতিথি আপ্যায়ন বা কোনও শুভ কাজ উজ্জাপনের জন্য আগে এখান থেকে কামান নিক্ষেপ করা হত। তাই গেটটি সালামি দরওয়াজা নামেও পরিচিতি লাভ করে। বাংলায় মুসলিম শাসন আমলে নির্মিত এই প্রবেশদ্বারটি ইহার সুদৃঢ় নির্মাণশৈলী ও বিশাল আকৃতির জন্য মালদায় দেখার সেরা জায়গা হিসাবে পর্যটকদের কাছে দাখিল দরওয়াজা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

2. ফিরোজ মিনার

ফিরোজ মিনার

ফিরোজ মিনার দাখিল দরওয়াজা থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দূরে। গৌড়ের অন্যতম প্রধান আকর্ষন হলো দিল্লির কুতুব মিনারের আদলে তৈরি ফিরোজ মিনার। সুলতান সৈফুদ্দিন ফিরোজই ১৪৮৬ থেকে ১৪৮৯ সালের মধ্যে এই ফিরোজ মিনার নির্মাণ করেছিলেন। পাঁচতল বিশিষ্ট এই মিনারটির উচ্চতা প্রায় ২৫.৬০ মিটার এবং মোট তিয়াত্তরটি ধাপ বিশিষ্ট সর্পিল সিঁড়ি পেরিয়ে ইহার শীর্ষে পৌঁছানো যায়।

দিল্লির কুতুব মিনারের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল এই মিনারটি। তুঘলকি স্থাপত্যশৈলীতে ৮৪ শঙ্খ প্যাচ সিরি বিশিষ্ট এই পাঁচতলা ফিরোজ মিনার চিরাগদানি মিনার নামেও পরিচিত। পোড়ামাটির নিখুঁত শিল্পশৈলীও লক্ষ্য করা যায় এই মিনারের দেওয়ালগুলিতে। এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি পীর আশা মন্দির বা চেরাগদানি নামেও খ্যাত।

3. লুকোচুরি দরওয়াজা

লুকোচুরি দরওয়াজা

মালদার সেরা দেখার জায়গা হিসাবে লুকোচুরি দরওয়াজা একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য। লুকোচুরি গেট বা লুকোচুরি দরওয়াজা কে নির্মাণ করেছিলেন সেই নিয়ে বহু মতভেদ আছে। ১৬৫৫ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র তৎকালীন বাংলার সুবেদার শাহ সুজা গৌড়ে এই শাহী দরওয়াজাটি নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। এখানেই নাকি বেগমের সাথে লুকোচুরি খেলতেন সুলতান।

আবার কিছু ঐতিহাসিকদের মতানুসারে এই মুঘল স্থাপত্যটি ১৫২২ সালে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ নির্মাণ করেছিলেন। এই দ্বিতল দরওয়াজাটি গৌড় দুর্গের পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং সেই সময় দুর্গের প্রধান প্রবেশ দ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হত। এর উপরিভাগকে সম্ভবত নহবতখানা হিসাবে ব্যবহার করা হত। তৎকালীন মুঘল স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন এই লুকোচুরি দরওয়াজা।

4. চিকা মসজিদ

চিকা মসজিদ

গৌড়ের আরেকটি দর্শনীয় নিদর্শন হল চিকা মসজিদ। জেনে নেওয়া যাক আরও একটি মালদা জেলার দর্শনীয় স্থান সম্বন্ধে। ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদটি সুলতান ইউসুফ শাহ গৌড়ে নির্মাণ করেছিলেন। তবে এই স্থাপত্যটি আদতে মসজিদ না সমাধিস্থল তা নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব আছে।

জনশ্রুতি রয়েছে সুলতান হুসেন শাহের আমলে ইহা কারাগার রূপে ব্যবহৃত হত। একদা এই মসজিদ হয়ে উঠেছিল চামচিকাদের আশ্রয়স্থল, তাই এই মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে চিকা বা চামকান মসজিদ। বহু কারুকার্য করা পাথর ও মীনা করা ইঁট হিন্দু মন্দির থেকে নিয়ে এসে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। দেওয়ালগুলিতে অপূর্ব শৈলাতে খোদাই করা নকশা, দরজা এবং লিনটেলের পাথরের উপর হিন্দু মূর্তির চিত্রগুলি এখনও আংশিকভাবে দৃশ্যমান।

5. রামকেলি মন্দির

রামকেলি মন্দির

মালদা থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে গৌড়ের পথে যেতে একটি ছোট্ট গ্রাম রামকেলি। বৈষ্ণবদের গুপ্ত বৃন্দাবন হিসেবে পরিচিত এই রামকেলি মন্দিরে স্বয়ং চৈতন্যদেব এসেছিলেন এবং তার পদযুগলের চিহ্ন এখনো এখানকার একটি মন্দিরে রাখা আছ। রামকেলিতে রূপসাগর, শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড, ললিতাকুণ্ড, বিষধাকুণ্ড, সুরভীকুণ্ড, রঞ্জকুণ্ড ও ইন্দুলেখাকুণ্ড এই আটটি কুণ্ড দ্বারা সেই পদচিহ্ন পরিবেষ্টিত আছে।

এখানে প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু হয় বিরাট রামকেলির মেলা। এই মেলায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের পসার নিয়ে বসে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা এমনকি বাংলাদেশ থেকেও ভক্ত দর্শনার্থীদের ভিড় জমে এই মেলায়। সারা দিন ধরে চলে কীর্তন। গ্রামবাসীদের মনোরঞ্জনের জন্য যাত্রাপালার আসর বসে এই সময়। ধর্মীয় তাৎপর্যের দিক দিয়ে মালদায় দেখার সেরা জায়গা হিসাবে এই রামকেলি গ্রাম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান।

6. বারোদুয়ারি মসজিদ

বারোদুয়ারি মসজিদ

রামকেলি গ্রাম থেকে মাত্র পাঁচশো মিটার দূরে গৌড়ে অবস্থিত বারোদুয়ারি বা বড় সোনা মসজিদ। এই বিশালাকার প্রাচীন মসজিদটি গৌড়ের বৃহত্তম স্মৃতিস্তম্ভ। ইট এবং পাথরের তৈরি বিশাল আয়তাকার কাঠামোযুক্ত বৃহত্তম স্মৃতিসৌধের নামের অর্থ দ্বাদশ দরজা হলেও এখানে আসলে এগারোটি দরজা রয়েছে।

আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসন আমলে এই মসজিদটির নির্মাণ কার্য শুরু হয়েছিল। সেই নির্মাণ কার্য ১৫২৬ সালে তাঁর পুত্র নাসিরুদ্দিন নুসরাত শাহ সম্পন্ন করেন। বারোদুয়ারি মসজিদে লক্ষ্য করা যায় ইন্দো আরবি স্থাপত্যশৈলীর ছোঁয়া। পাথরের উপর খোদাই করা ভাস্কর্য এখানকার প্রধান আকর্ষণ।

7. আদিনা মসজিদ

আদিনা মসজিদ

মালদায় দেখার সেরা জায়গা হিসেবে সুলতান সিকান্দার শাহের নির্মিত আদিনা মসজিদ নিজের এক বিশেষে জায়গা করে নিয়েছে। ১৩৬৯ সালে এই মসজিদটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদটি সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে অবস্থিত উমাইয়া মসজিদের আদলে নির্মাণ করা হয়।

ভারতের অন্যতম বৃহৎ মসজিদগুলির মধ্যে পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ অন্যতম। নাম উল্লেখযোগ্য। অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত এই মসজিদের নকশা বাংলা, আরব, ফার্সি ও বাইজেন্টাইন স্থাপত্য অন্তর্ভুক্ত

8. একলাখী সমাধিসৌধ

একলাখী সমাধিসৌধ

মালদার আদিনার ঠিক আগেই একলাখীতে অবস্থিত একটি সমাধি সৌধ যার এক নাম আছে গোলঘর। একলাখী সমাধিসৌধে মোট তিনটি সমাধি রয়েছে। অনুমান করা হয় এর মধ্যে একটি সমাধি রাজা গণেশের পুত্র জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহের এবং বাকী দুটি সমাধি তাঁর স্ত্রী ও পুত্র শামসুদ্দিন আহমদ শাহের। রাজা গণেশ ছিলেন দিনাজপুরের ভাতুরিয়ার জমিদার, তারপর তিনি নিজ ক্ষমতায় রাজা হয়ে গৌড়ের সিংহাসনে বসেছিলেন। তার ছেলে পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পিতা কে সরিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করেন।

সেই সময়ে এই সমাধিটি নির্মাণ করতে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল, তাই এটির এরকম নামকরণ করা হয়েছে। এই সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি প্রাক-ইসলামী বাংলার ইঁটের তৈরি মন্দিরের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল। এই সমাধিসৌধটির দেওয়াল গাত্রে রয়েছে অপরূপ পোড়ামাটির অলঙ্করণ।

9. জগজীবনপুর বৌদ্ধবিহার

জগজীবনপুর বৌদ্ধবিহার

মালদা জেলার হবিবপুর ব্লকের বাংলাদেশ বর্ডারের খুব কাছেই জগজীবনপুর নামে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান রয়েছে। পাল সম্রাট মহেন্দ্রপালদেবের একটি তাম্র ফলক শিলালিপি এই স্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল। এছাড়াও এই স্থানে রয়েছে নবম শতাব্দীর একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের নিদর্শন বেরিয়ে আসে, যাকে জগজীবনপুর মহাবিহার হিসেবে ডাকা হলেও এর নাম নন্দদির্ঘীকা উদ্রঙ্গ মহাবিহার

এই বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে পাল আমলের ও রাজ বংশের অনেক অজানা ইতিহাস জানা যায়। এই স্থানটিতে অনেকগুলি ঢিবি রয়েছে, যেগুলির মধ্যে সর্ব বৃহৎ ঢিবিটির নাম তুলাঢিবি বা সালাইডাঙ্গা। এছাড়া আখড়িডাঙ্গা, নিমডাঙ্গা, নন্দনগড় ও রাজার মায়ার ঢিপি নামক আরও চারটি ঢিপি রয়েছে এখানে। এছাড়াও এখনও এখানে বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে নন্দাদিঘি নামক একটি দীঘি।

10. জহুরা কালী মন্দির

জহুরা কালী

তিনশো বছরের পুরোনো মালদার প্রাচীন জহুরা কালী মন্দির ভক্তদের মনে অত্যন্ত জাগ্রত। স্থানীয়দের অনেকের মতে এই মন্দিরের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের ও বেশী পুরনো। সেন বংশের রাজা বল্লাল সেনের আমলে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা বলে মনে করা হয়। এখানে কোনো মূর্তি পুজো হয়না, এখানে মায়ের মুখোস তৈরি করে পুজো করা হয়, যে মুখোস মালদা শহরেরই একটি পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে করে চলছে।

এই মন্দির থেকে জায়গাটির নাম পরিচিত হয়েছে জহুরাতলা নামে। পুজো কেবলমাত্র মঙ্গল ও শনিবারেই হয়ে থাকে, বাকি দিনগুলিতে মন্দির বন্ধ থাকে। এই জহুরা কালী মন্দিরের পাশেই কিছুদূরে আরো একটি প্রাচীন মন্দির আছে যেটি একটি সূর্য মন্দির, অনেকে একে প্রাচীন জহুরা কালী মন্দির হিসেবেও মনে করে থাকে। আসলে অবশ্যই এই মন্দিরটিও দর্শন করে যাবেন।

কিভাবে যাবেন – এখানে আসা খুবই সহজ, মালদা শহর থেকে একটা টোটো রিজার্ভ করে নিয়ে সহজে চলে আসতে পারেন জহুরা কালী মন্দির। দুরত্ব মাত্র ৮ কি.মি। বাইক নিয়ে বা পার্সোনাল গাড়ি নিয়ে আসতে চাইলে মালদা শহর থেকে বিপিন ঘোষ রোড ধরে এখানে পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় ৩০ মিনিট।

মালদা জেলায় বেড়াবার জায়গা সম্পর্কে

সবশেষে বলা যায় মালদা জেলার বেড়াবার জায়গাগুলি মুলত ঐতিহাসিক স্থান, তাদের স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক মানিক্যগুলি প্রতিটি ভ্রমণকারীকে বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা লাভকরার সুযোগ দেয়। আপনি যদি একজন ইতিহাসপ্রেমী, প্রকৃতিপ্রেমী হন বা কেবল মাত্র প্রশান্তি সন্ধানি, মালদা জেলা আপনাকে অনেক কিছ দিতে পারে। তাই আপনার ব্যাগ প্যাক করুন, জেলাটি ঘুরে দেখুন আর এই জেলার সৌন্দর্য এবং ইতিহাসে নিজেকে নিমজ্জিত করুন।


আরও পড়ুনঃ বাঁকুড়া জেলার সেরা বেড়ানোর জায়গাগুলি

Leave a Comment