ঘাটশিলা ঝাড়খন্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার সেই ছোট্ট শহর যেটি অনুচ্চ পাহাড়, টিলা, সুবর্ণরেখা নদী, মন্দির নিয়ে কালজয়ী সাহিত্যিক বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিধন্য। ঘাটশিলা ভ্রমণ করার প্রধান কারন হিসাবে বলা যায় এই পাহাড় জঙ্গল নদীর অমোঘ টান। হয়তো ঠিক এই কারনে “আরণ্যক”-এর স্রষ্টাও বাসা বেঁধেছিলেন এখানেই, সুবর্ণরেখার তীরে। ১৯৫০ সালে এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রকৃতির সন্তান, অপামর বাঙালির চোখে নিসর্গের মায়া-কাজল এঁকে দেওয়া বিভূতিভূষণ।
কিসের টানে ঘাটশিলা ভ্রমণ
অরণ্য পাহাড় নদী ঝর্ণা হ্রদ; বাংলাভাষী হিন্দিভাষী আদিবাসী; পরব মেলা মাদলের বোল, এ-সবই ঘাটশিলা ভ্রমণ করার বড় পাওয়া। সময় এগিয়েছে। নগরায়ণের ছোঁয়া লেগেছে ঘাটশিলাতেও। তা বলে হারিয়ে যায়নি সুবর্ণরেখা। হেঁটে হেঁটে নানা জায়গায় বেড়াতেন বিভূতিভূষণ। তাঁর “আরণ্যক” উপন্যাসের সেই ফুলডুংরি পাহাড়, এখনো যেতে পারেন সেই সুন্দর ছোট্ট পাহাড়ে। ঘাটশিলার প্রান সুবর্ণরেখা নদী, কথিত আছে এই নদীর বালুতটে নাকি সোনা পাওয়া যেত, তাই এর নাম সুবর্ণরেখা। ঘাটশিলা ভ্রমণের প্রতি মুহুর্তে সুবর্ণারেখা বাঙালির মনকে যেন ছুঁয়ে যায় বাংলা সাহিত্যের হাত ধরে। অনেকে বলেন সুবর্নরেখা নদীর ঘাটে শত শত শিলা শায়িত বলে নাকি এই স্থানের নামকরণ করা হয়েছে ঘাটশিলা।
কিভাবে যাবেন ঘাটশিলা
- বিমান পথে – কাছাকাছি বিমান বন্দর হর রাঁচি, যা এখান থেকে ১৫৬ কিমি দূরে। রাঁচি থেকে সড়ক পথে প্রায় ৩ ঘন্টা লাগবে। আরেকভাবে কলকাতা বিমান বন্দর, তারপর ট্রেনে ঘাটশিলা।
- সড়ক পথে – কলকাতা থেকে দূরত্ব ২৪০ কিমি, যেতে সময় লাগে ৫ ঘন্টার মত। কলকাতা থেকে গাড়িতে ঘাটশিলা যেতে হলে খড়গপুর – বাহাড়গোড়া – ধলভূমগড় হয়ে ঘাটশিলা যাওয়া যায়। যদিও বাহাড়গোড়া থেকে ঘাটশিলা অবধি রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। আরেকভাবেও যেতে পারেন তা হল – খড়গপুর হয়ে লোধাসুলি থেকে ডানদিকে ঝাড়গ্রামের দিকে বেঁকে চিল্কিগড় – জামবনি – পাড়িহাটি – চাকুলিয়া – ধলভূমগড় হয়ে ঘাটশিলা পৌছান যায়।
- ট্রেনে গেলে – কলকাতা থেকে দূরত্ব ২১৫ কিমি, যেতে সময় লাগে ৩ বা সাড়ে ৩ ঘন্টা। হাওড়া থেকে ঘাটশিলা ভ্রমণের জন্য জনশতাব্দী এক্সপ্রেস সবথেকে দ্রুত, এটি সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ছাড়ে। এছাড়াও রয়েছে হাওড়া ইস্পাত এক্সপ্রেস,স্টিল এক্সপ্রেস, টাটানগর ফেস্টিভ্যাল স্পেশাল।
ঘাটশিলা নামার পর স্টেশনে চত্ত্বরেই অনেক কিছু অটো এবং গাড়ি আছে। অটোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখার নির্দিষ্ট ভাড়া বেঁধে দেওয়া আছে। সেগুলির কোনও একটি ভাড়া করে নিলে সারা দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। ঘাটশিলার দর্শনীয় স্থানগুলি গাড়ি করেও দেখে নিতে পারবেন। তবে গাড়ির কোনও নির্দিষ্ট ভাড়া নেই, আপনাকে দরদাম করে নিতে হবে। হ্যাঁ এটাই ঘাটশিলা ভ্রমণের প্রথম পদক্ষেপ। তবে আগে থেকে বুক করে গেলে সুবিধা হবে। গুগলে ঘেঁটে ঘাটশিলার অটো কিংবা গাড়ির ড্রাইভারের ফোন নম্বর পেয়ে যাবেন।
ঘাটশিলা দর্শনীয় স্থান – Ghatshila tourist spots
1. ফুলডুংরী
ফুলডুংরী টিলা ওখানকার বিখ্যাত পাহাড় যা ঘাটশিলা থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে জাতীয় হাইওয়েতে অবস্থিত। একটি সর্পিল পথ রয়েছে যার মধ্য দিয়ে যে কেউ পাহাড়ের চূড়ায় যেতে পারে। পাহাড়টি প্রচুর পরিমাণে লম্বা শাল গাছ এবং এর পথটি লাল নুড়ি দ্বারা আবৃত। ফুল্ডুংরির পাহাড়ে চড়তে চড়তে নাম না জানা বুনোফুল গন্ধ পাচ্ছিলাম। এই গন্ধের একটা আলাদা মাধুর্য আছে। তো আমরাও একটা জায়গায় এসে পৌঁছালাম। সেখান থেকে চারপাশের পরিবেশ টা খুব সুন্দর দেখতে লাগছিল। আরও কিছুদূর যাওয়ার পরে দেখলাম উপরে একটি ছোটো পাঁচিল ঘেরা জায়গা। বুঝতে বাকি রইল না ঐ উপরের অংশটাই পাহাড়ের মাথা। সেখানে একটি মাচা করা আছে। বুঝলাম ওই মাচার নিচে বসেই বিভূতিভূষণ সাহিত্য রচনা করতেন। পাহাড়ের চূড়া থেকে ঘাটশিলা শহরের একটি দুর্দান্ত দৃশ্য দেখতে পারবেন।
2. ধারাগিরি ফলস
ঘাটশিলার দর্শনীয় স্থান বললে সবার আগে বলতে হয় ধারাগিরি জলপ্রপাত, যেটি ঘাটশিলা থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এটি ধারাগিরি পাহাড় থেকে ২১ ফুট নিচে নেমে আসা এই জলপ্রপাতটি দেখতে ভাল লাগবে শুধু বর্ষার আগে মাস দুয়েক প্রায় জলশুন্য থাকে। এখানে একটি অতি প্রাচীন কালী মন্দিরও আছে। এই অঞ্চলটি একটি বনাঞ্চল পাহাড়ী ধরণের। যারা অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং পছন্দ করেন তারা এটি বিশেষ পছন্দ করবেন। পাথুরে পথ ধরে হাইকিং করে যেতে হবে। তবে শীতকালে ঘাটশিলা ভ্রমণ করলে এই রাস্তাই সবথেকে আকর্ষনিয় হয়।
3. বুরুডি লেক
ঘাটশিলা থেকে ৬ কিমি উত্তরে বুরুডি লেকটি অবস্থিত। লেকের চারপাশে শাল পিয়ালের বন। দলমা পাহাড়ে ঘেরা বুরুডি ড্যাম ও জলাধারের শান্ত সৌন্দর্যময় পরিবেশ নিশ্চিতভাবে বলা যায় ভালো লাগবে। বোটিংয়ের ব্যবস্থা আছে। জলাধারের মাঝামাঝি জায়গা থেকে চারপাশটা স্বপ্নের মতো মনে হয়। আবার “বিন্দা মেলা” প্রতিবছর অক্টোবর মাসে হ্রদের তীরে ঘাটশিলায় পনের দিনের জন্য অনুষ্ঠিত হয়। এটি বিশেষত সাঁওতাল উপজাতির জন্য খুব জনপ্রিয় একটি নৌকাখেলা। এখানে বোটিং করার সুযোগ রয়েছে। বোটিং করার জন্য জন প্রতি ৫০/- টাকা টিকিট লাগে।
4. রঙ্কিনীদেবীর মন্দির
রঙ্কিনী কালী মন্দিরটি কালিমাতার উপাসনা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল, এটি “রঙ্কিনী মাতা” নামে পরিচিত। শোনাযায় ঘাটশিলার মন্দিরে অতীতে নরবলী হত। স্থানীয় লোকদের মধ্যে রঙ্কিনী দেবী অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং লোকজন মা রঙ্কিনী দেবীর শক্তি এবং প্রভাবকে বিশ্বাস করেন। আপনি যাদুগোড়া পাহাড়েও ভ্রমণ করতে পারেন যা এই মন্দিরের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত।
5. রাতমোহনা
গৌরীকুঞ্জ থেকে নদীতীর ধরে খানিকটা নেমে গেলে রাতমোহনা। রাতমোহনা আসলে একটি ভিউ পয়েন্ট। রাতমোহনা থেকে সুবর্ণরেখায় সূর্যাস্তের জাদুকরী দৃশ্য বহুদিন স্মৃতিতে জাগ্রত হয়ে থাকবে। আর মৌভাণ্ডার সেতু থেকে সকালের সুবর্ণরেখা, অসম্ভব সুন্দর সেই সুর্যোদয়ের দৃশ্য।
6. পঞ্চ পান্ডব পাহাড়
ঘাটশিলা থেকে উত্তর-পূর্বে প্রায় ৫ কিমি দূরে গুলমা জেলায় এই পঞ্চপাণ্ডব। পাঁচটি টিলা পাহাড় একত্রে পঞ্চপাণ্ডব পাহাড়। আঞ্চলিক মানুষের বিশ্বাস, দ্রোপদী-সহ মহাভারতের পাণ্ডব ভ্রাতারা এখানে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। একটি ছোট মন্দির আছে এখানে। পঞ্চপাণ্ডব অঞ্চল থেকেও সুবর্ণরেখায় চমৎকার সূর্যাস্ত দেখা যায়।
7. গালুডিহি ব্যারেজ
গালুডি বা গালুডিহি বাঁধ মূলত সূর্যাস্তের সময় অপূর্ব লাগে এই ব্যারেজ দেখতে। কাছেই রয়েছে আদিবাসীদের গ্রাম। হেঁটে হেঁটে যেতে, ভ্রমণ প্রেমীদের ভালোই লাগবে।
7. গৌরী কুঞ্জ
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িটি এখন একটি সংগ্রহশালা। লেখকের প্রথমা স্ত্রী গৌরীদেবীর নামে সংগ্রহশালার নামকরণ হয়েছে “গৌরীকুঞ্জ”। লেখকের ব্যবহার করা নানা সামগ্রী সংরক্ষিত আছে এখানে। গৌরীকুঞ্জের দেওয়ালে ঝাড়খণ্ডের জনজাতির পট শিল্প “পটগার” শৈলীতে লেখকের জীবনের টুকরো টুকরো নানা ছবি অঙ্কিত হয়েছে। “অপুর পাঠশালা” নামে একটি স্কুলও চলে গৌরীকুঞ্জে। ঘাটশিলা ভ্রমণ সত্যই অসম্পুর্ন থকে যাবে এই গৌরিকুঞ্জ দর্শন ছাড়া।
এছাড়াও ঘাটশিলায় দর্শনীয় স্থান আরও অনেক রয়েছে যেমন ঘাটশিলা ফলস, সিদ্ধেশর পাহাড়ের শিব মন্দির, নারোয়া ফরেস্ট, হিন্দুস্তান কপার লিমিটেড, পূর্ণ পানি, মোসাবোনি খনি, যাদুগোড়া, সুরদা পাহাড়, মৌভান্ডার, তুমানডংগ্রি, সুবর্ণরেখা, কেরুকোচা, বাবা ভৈরব ইত্যাদি স্থান। ঘাটশিলা ঝাড়খণ্ডের স্থানীয় দর্শকদের কাছে পিকনিক স্পট হিসাবেও বিখ্যাত।
কাছেপিঠে দেখার ও বেড়াবার জন্য ঘাটশিলা কিন্তু দারুন একটি জনপ্রিয় জায়গা। এখানে যেমন সুন্দর দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা নিমেষেই আপনার মন ভালো করে দেবে। তাই আর দেরী না করে দেখে নিন এমন কিছু ভ্রমণ গন্তব্য, যা রয়েছে আপনার হাতের নাগালেই রয়েছে।
ঘাটশিলায় থাকার জায়গা
ঘাটশিলা স্টেশনের কাছাকাছি রয়েছে নানা মান ও দামের হোটেল। রাতমোহনা ভিউপয়েন্টের কাছে আছে হোটেল রাতমোহনা ইন। ঘাটশিলার দহিগোড়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে থাকার জন্য রয়েছে রামকৃষ্ণ মঠের অতিথিশালা।
চাইলে ঘুরতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করলে বুরুডি লেকের আশেপাশে খাওয়ার হোটেল রয়েছে আর দাম ও কম সেখানে ভাত ডাল মাছ মাংস ডিম নিরামিষ সব ধরনের খাবার পাবেন।
ঘাটশিলা যাওয়ার সেরা সময়
গরমকাল বাদ দিয়ে যে কোনো সময় আসতে পারেন। তবে বর্ষাকাল ও শীতকাল দুটি সময়েই ঘাটশিলা তার ভিন্ন রূপে অপরূপ। বর্ষায় যেমন সমস্ত পাহাড় ও জঙ্গল একদম সবুজ থাকে তেমনি সমস্ত ঝর্না জলে পরিপুর্ন থাকে। আবার শীতকালে এখানকার জঙ্গলের গাছ থেকে পাতা ঝরতে থাকে লতাগুল্ম একটু কম থাকে যেটা অ্যাডভেঞ্চার ট্রেক করার পক্ষে আদর্শ। সারা বছরই এখানে আসুন আর আলাদা আলাদা ঋতুর আনন্দ নিন।
আরও পড়ুনঃ রাঁচি ভ্রমণ সাথে সেরা ১২টি দর্শনিয় স্থান
ঘাটশিলার ইতিহাস
ঘাটশিলা যে ঝাড়খণ্ডের পুর্ব সিংভুম জেলায় অবস্থিত তা আমি প্রথমেই বলেছি কিন্তু বাঙালির মননে ঘাটশিলার উপস্থিতি ভীষণ জোরালো। কত যে গল্প, উপন্যাস, কবিতায় ছড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের কথা। একসময় কলকাতার বাবুদের রোগমুক্তির অন্যতম ঠিকানা ছিল এই ঘাটশিলা।
ঘাটশিলা হোটেল ভাড়া
ঘাটশিলাতে বাজেট হোটেল ৫০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা এবং একটু প্রিমিয়াম হোটেলের ভাড়া মোটামুটি ১৫০০ থেকে ৩৫০০ মধ্যে।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷
খুব তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।