পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় উদ্যান, সেরা অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণ গন্তব্য

পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় উদ্যান

পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় উদ্যান যে শুধু অভয়ারন্য, তা নয়, এগুলি আপনার ভেতরকার আডভেঞ্চারারকে টেনে বের করে আনতে সক্ষম। তবে সেসব জানার আগে – হে ভ্রমণপিপাসু মানুষ, শুনুন! আপনি কি একই পুরানো সৈকত ভ্যাকেসন এবং শহুরে গন্তব্য দেখে ক্লান্ত? আপনি কি অদম্য আদিম শক্তির স্বাদ পেতে চান, যেমন ধরুন বন্যের একেবারে গা ঘেঁষা দুরত্বে হাজির হলেন এবং এমন একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন যা আপনার অ্যাড্রেনালিন একেবারে টিকিতে চড়িয়ে দিয়ে আপনার আত্মাকে তৃপ্ত করবে।

তাহলে আপনার ব্যাগ প্যাক করা শুরু করুন। পরখ করুন পশ্চিমবঙ্গ কেমন সত্যই প্রকৃতি প্রেমী এবং বন্যপ্রাণী উত্সাহীদের জন্য একটি স্বর্গরাজ্য। পশ্চিমবঙ্গে একটি, দুটি নয়, ছয়টি জাতীয় উদ্যান রয়েছে যা নিয়ে গর্ব করা যেতে পারে। প্রতিটি উদ্যানই এক একটি রত্ন, যা আপনার আবিস্কারের অপেক্ষায়। একবার দেখে নেওয়া যাক উদ্যানগুলি

1. সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান:

সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান
Picture credit : theearthsafari.com

পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় উদ্যান, একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, পশ্চিমবঙ্গের বন্যপ্রাণী সংরক্ষনের জগতে সর্বাগ্রে। এটিকে আপনার ভ্রমণ মানচিত্রে স্থান দিন: এটি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, নোনা জলের কুমির, ঘড়িয়াল, দাগযুক্ত হরিণ এবং রাজকীয় রয়েল বেঙ্গল টাইগারে ভরা। সেই অধরা ডোরাকাটা রাজার জন্য আপনার চোখ খোলা রেখে একটি বোট সাফারিতে চড়ে বসুন এবং গোলকধাঁধার জলপথের আনন্দ নিন।

সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যঃ

  • পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত।
  • সুন্দরবনে প্রচুর সুন্দরী গাছ দেখা যায়। এই গাছের নামেই সুন্দরবন নামাঙ্কিত।
  • ১৯৭৩ সালে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প, ১৯৮৪ সালে এটি জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষিত হয়।
  • ১৯৮৭ সালে এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ও ২০১৯ সালে সুন্দরবনকে রামসর সাইটের মর্যাদা দেওয়া হয়।
  • ক্যানিংকে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার বলা হয়।

এই জাতীয় উদ্যানে কি কি করা যেতে পারে?

2. জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান:

জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান
Picture credit : dooarstrip.com

এই উদ্যানটি পাখিদের স্বর্গ, যেখানে ২০০ টিরও বেশি প্রজাতির পাখি রয়েছে। হর্নবিল, ঈগল এবং এমনকি অধরা লাল ব্রেস্টেড কাঠঠোকরার জন্য আপনার দূরবীনগুলি হাতের কাছে রাখুন। এবং যদি আপনি ভাগ্যবান হন তবে আপনি একশৃঙ্গ গন্ডার বা অধরা এশিয়ান হাতির দেখা পেতে পারেন!

জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যঃ

  • জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান আলিপুরদুয়ার জেলায় হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত।
  • তোর্সা নদীর তীরে এই জাতীয় উদ্যান অবস্থিত।
  • ১৯৪১ সালে জলদাপাড়াকে বন্যপ্রাণ অভ্যয়ারণ্যের তকমা দেওয়া হয়।
  • ২০১২ সালে এটি জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা পায়।
  • এই উদ্যানের প্রধান আকর্ষণ হলো এশীয় একশৃঙ্গ গন্ডার। এছাড়া রয়াল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, সম্বর হরিণ, মায়া হরিণ, চিতল হরিণ, হগ ডিয়ার, বুনো শুয়োর, গৌর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও সরীসৃপ দেখতে পাওয়া যায়।

এই জাতীয় উদ্যানে কি কি করা যেতে পারে?

3. নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান:

নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান
Picture credit : trawell.in

হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত, নেওরা ভ্যালি একজন ট্রেকারের স্বপ্ন। রডোডেনড্রন বন, প্রাচীন ঝর্ণা ধারার মধ্য দিয়ে হাইক করুন এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতের স্বর্গিয়ো সৌন্দর্যের সাক্ষী হন। লাল মাথার ট্রগনের কিচিরমিচির এবং হিমালয় তাহরের ঘেউ ঘেউ করার জন্য আপনার কান খোলা রাখুন।

নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যঃ

  • নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান পশ্চিমবঙ্গের কলিম্পং জেলায় অবস্থিত।
  • ১৯৮৬ সালে এটি জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষিত হয়।
  • লাল পান্ডার জন্য এই জাতীয় উদ্যানটি বিখ্যাত।
  • বন্যপ্রাণীর মধ্যে বাঘ, চিতাবাঘ, বনবিড়াল ও কালো ভাল্লুক, কাঠবিড়ালি, লাল পাণ্ডা, দেশি বনরুই, সম্বর হরিণ, গোরাল, বন ছাগল বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ইত্যাদি।
  • এই জাতীয় উদ্যানে খয়ের, শিশু, শিরীষ প্রভৃতি গাছ দেখা যায়।

এই জাতীয় উদ্যানে কি কি করা যেতে পারে?

4. গোরুমারা জাতীয় উদ্যান:

গোরুমারা জাতীয় উদ্যান
Picture credit : holidayhotspot.info

গোরুমারা জাতীয় উদ্যান হিমালয়ের কোলে জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত। গোরুমারার অবিসংবাদিত রাজারা হল পরাক্রমশালী ভারতীয় গন্ডার এবং অধরা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এই দুর্দান্ত প্রাণীগুলিকে তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থলে দেখা একটি অভিজ্ঞতা চিরকাল স্মৃতিতে খোদাই করা। লম্বা তৃণভূমি এবং ঘন বনের মধ্য দিয়ে জিপ সাফারিগুলি তাদের মহিমান্বিত উপস্থিতি আভাস দেওয়ার সুযোগ দেয়, সম্ভবত একটি গন্ডারের শিং বা বাঘের ক্ষণস্থায়ী ডোরা গাছের পাতায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সূর্যালোকের এক ঝলক।

গোরুমারা জাতীয় উদ্যান সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যঃ

  • গোরুমারা জাতীয় উদ্যান জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত।
  • ১৯৯৪ সালের ৩১শে জানুয়ারি এটি ভারতের একটি জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা পায় ।
  • জলঢাকা নদী এই জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়েছে।
  • লাটাগুড়ি শহরকে এই জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বার বলা হয়।
  • বন্যপ্রাণীদের মধ্যে হাতি, গণ্ডার, গউর, হরিণ, বুনো শুয়োর, ময়ূর প্রভৃতি পশুপাখি উল্লেখযোগ্য।
  • এই উদ্যান ঘিরে স্থানীয় রাভা, রাজবংশী, মেচ, কোঁচ, ওঁরাও, মুন্ডা ও টোটো উপজাতির মানুষ বাস করে।

এই জাতীয় উদ্যানে কি কি করা যেতে পারে?

5. সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান:

সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান
Picture credit : birderpics.com

সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক একটি ভিন্ন ধরনের ট্রেকারদের স্বর্গ। হিমালয়ের মনোরম দৃশ্য সহ ভারত ও নেপালের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক সীমান্ত সিঙ্গালিলা রিজ ধরে হাঁটার কল্পনা করুন যা আপনার নিঃশ্বাস কেড়ে নেবে। অধরা তুষার চিতা, বিস্ময় উদ্রেককারী হিমালয়ের কালো ভাল্লুক এবং বিরল কস্তুরী হরিণ দেখুন।

সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান সম্পর্কে কিছু প্রয়জনীয় তথ্যঃ

  • সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান দার্জিলিং জেলায় নেপাল পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমের সীমান্তে এই জাতীয় উদ্যানের অবস্থিতি।
  • লাল পান্ডা এই জাতীয় উদ্যানটিতে সবথেকে আদর্শ পরিবেশে থাকে।
  • ১৯৮৬ সালে এটি বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য এবং ১৯৯২ সালে জাতীয় উদ্যানের তকমা পায়।
  • পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সান্দাকফু ট্রেকিং- এই জাতীয় উদ্যান থেকে যাত্রা শুরু করতে হয়।
  • প্রাণীর ভেতরে দেখা যায় লাল পান্ডা, সোনালী বিড়াল, বনবিড়াল ও কালো ভাল্লুক।
  • এই জাতীয় উদ্যানে ওক, হেমলক, রূপালি দেবদারু, রূপালি ফার জাতীয় গাছ, বার্চ প্রভৃতি বৃক্ষ দেখা যায়।

এই জাতীয় উদ্যানে কি কি করা যেতে পারে?

6. বক্সা জাতীয় উদ্যান:

বক্সা জাতীয় উদ্যান
Picture credit : fivecolorsoftravel.com

বক্সা জাতীয় উদ্যান বা বক্সা টাইগার রিজার্ভটি জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার। বিশাল এশিয়ান হাতি থেকে কৌতুকপূর্ণ স্লথ ভালুক পর্যন্ত, বক্সা জাতীয় উদ্যান এই সব ধরণের বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। একটি জীপ সাফারি নিন এবং সবুজ বনে অন্বেষণ করুন, বা বক্সা নদীর কাছে পাখি দেখার জন্য যান। আপনি এমনকি অধরা বেঙ্গল টাইগার দেখতে পারেন, তাই আপনার চোখ খোসা রাখুন!

বক্সা জাতীয় উদ্যান সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যঃ

  • বক্সা জাতীয় উদ্যান পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলায় অবস্থিত। উদ্যানের উত্তর সীমাটি হল ভারত-ভুটান আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও সিঞ্চলা পর্বতমালা। দক্ষিণ-পশ্চিমের চিলাপাতা বনাঞ্চলটি বক্সা ও জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের মধ্যে একটি এলিফ্যান্ট করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
  • ১৯৮৩ সালে টাইগার রিজার্ভ হিসেবে বক্সা টাইগার রিজার্ভ স্থাপিত হয়েছিল।
  • ১৯৮৬ সালে বক্সা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১৯৯৭ সালে সরকার এটিকে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দেয়।
  • বক্সা জাতীয় উদ্যানের মধ্যে বক্সা দুর্গ নামে একটি পুরনো দুর্গ আছে। দুর্গটিতে ব্রিটিশ যুগে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিনা বিচারে এখানে বন্দি করে রাখা হত।
  • বক্সা জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে রায়ডাক ও জয়ন্তী নদী বয়ে গিয়েছে।

এই ন্যাশনাল পার্কগুলিতে বাঘ বা গন্ডার ছাড়া আর কি?

পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় উদ্যানগুলি কেবল বাঘ এবং গণ্ডার দেখার চেয়ে বেশি কিছু দেয়। এখানে আরও রোমাঞ্চক কিছু অভিজ্ঞতা, আপনি অর্জন করতে পারেন যেমন:

  • জঙ্গল সাফারি: জিপ সাফারি, হাতির রাইড এবং বোট সাফারি সবই পাওয়া যায়, যা আপনাকে পার্কের বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং বন্যপ্রাণীর এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি দেয়।
  • পাখি পর্যবেক্ষণ: পশ্চিমবঙ্গে ৬০০ টিরও বেশি প্রজাতির পাখি রেকর্ড করা হয়েছে, পাখি পর্যবেক্ষকরা একটি ট্রিট হিসাবে পেতেই পারেন। সাইবেরিয়া থেকে রঙিন তিতির, হর্নবিল এবং এমনকি পরিযায়ী পাখির জীবন পর্যবেক্ষন করুন।
  • ক্যাম্পিং ও ট্রেকিং: খোলা আকাশের নীচে একটি তাঁবু তৈরি করুন বা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে একটা চ্যালেঞ্জিং ট্রেক শুরু করুন। প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং প্রশান্তি নিজের মনে, প্রানে মাখিয়ে নিন।
  • সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা: স্থানীয় গ্রামগুলিতে অবশ্যই যান এবং প্রকৃতির খুব কাছের লোকেদের অনন্য সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে জানুন।

আরও পড়ুনঃ বিস্তারিত জানুন পশ্চিমবঙ্গে অ্যাডভেঞ্চার কিভাবে করবেন

বন্য ও আদিম প্রকৃতিতে যারা বেড়াতে ভালবাসেন তাদের জন্য কিছু টিপস:

  • পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় উদ্যানগুলি দেখার সেরা সময় হল অক্টোবর থেকে মার্চের মধ্যে, যখন আবহাওয়া মনোরম হয়।
  • আরামদায়ক জামাকাপড় এবং জুতো অবশ্যই নেবেন, কারণ আপনার জন্য প্রচুর হাঁটা ও নতুন রোমাঞ্চের মুখোমুখি হওয়া অপেক্ষা করছে।
  • আপনার ক্যামেরা, বাইনোকুলার এবং সানস্ক্রিন যেন ভুলবেন না!
  • বন্যপ্রাণী এবং তাদের আবাসস্থলের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। আবর্জনা ফেলা এবং শব্দ করা এড়িয়ে চলুন।

তাহলে আর অপেক্ষা কেন। ব্যাগ গোছান শুরু হোক আপনার দুঃসাহসিকতার অর্জনের অনুভূতির জন্য। একটি অবিস্মরণীয় বন্যজীবনের অভিজ্ঞতার জন্য পশ্চিমবঙ্গের এই জাতীয় উদ্যানগুলিতে যান, যারা আপনাকে দুহাত তুলে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে (হয়তো কিছু খসখস আওয়াজ বা সাথে হালুম গর্জন)!

Leave a Comment