পূর্ব বর্ধমান জেলার সেরা ৭ দর্শনীয় স্থান

পূর্ব বর্ধমান জেলা

পূর্ব বর্ধমান জেলায় অসংখ্য জনপ্রিয় পর্যটন স্থল রয়েছে যেমন – কার্জন গেট, সর্বমঙ্গলা মন্দির, শের আফগানের সমাধি, কঙ্কালেশ্বরী কালী মন্দির, ১০৮ শিবমন্দির, জল্টুঙ্গির চাঁদনী পার্ক, ভাল্কিমাচান, কালনা রাজবাড়ী মন্দির, অট্টহাস সতী পীঠ মন্দির, রমনাবাগান জুলজিকাল পার্ক, কৃষক সেতু ও দামোদর নদ, ঝুলন্ত রেলওয়ে ব্রিজ প্রভৃতি আরও দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তবে আজ এখানে ৭ টি বিশেষ জায়গা সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করব।

পূর্ব বর্ধমান জেলার জনপ্রিয় পর্যটক স্থানগুলি


কার্জন গেট

কার্জন গেট

কার্জন গেট পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্যতম জনপ্রিয় একটি পর্যটন গন্তব্য এবং একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ যেটি শহরের একেবারে মাঝখানে অবস্থিত। বর্ধমানের শাসক মহারাজা বিজয় চাঁদ মাহাতাব এটি ১৯০৩ সালে লর্ড কার্জনের সফরের স্মরণে নির্মান করেছিলেন। লর্ড কার্জনের সম্মানে এই সৌধটির নামকরণ করা হয় তবে বর্তমানে এটি বিজয় তোরণ নামেও পরিচিত।

এই কার্জন গেট মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ের গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার স্থাপত্য নকশা অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছিল। সেই সময়ের ভাস্কর্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল গেট পিলারগুলি। গেটের দুই পাশে সিংহের ভাস্কর্য, কার্নিশ, শীর্ষে তিনটি পরী এবং অলংকরণ, যা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সৌধের স্থাপত্য দেখে পর্যটকরা বিস্মিত, বিমোহিত হয়।

গোলাপবাগ ও দার-উল-বাহার

দার-উল-বাহার

পূর্ব বর্ধমান জেলার বর্ধমান শহরের গোলাপবাগ বা গোলাপের বাগান একটি বেশ জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। এটি ১৮৮৩ সালে রাজা বিজয় চাঁদ মাহাতাব প্রতিষ্ঠিত বোটানিকাল এবং প্রাণিবিদ্যা সম্পর্কিত উদ্যান। এই শহরের আনন্দময় ও ব্যস্ত জীবন থেকে বিশ্রাম দেওয়ার সাথে সাথে শহরের প্রানবন্ত কেন্দ্র তথা হাওয়া মহল এবং গোলাপ বাগান প্রকৃতি প্রেমিদের মুগ্ধ করে।

হাওয়া মহল ইন্দো-সিরিয়ান স্থাপত্যের নিখুঁত মিশ্রণ। বিল্ডিংয়ের ভিতরে একটি উইন্ড-হলের বা হাওয়াঘর এর মাঝখানে একটি গভীর পুকুর রয়েছে। কিন্তু এই ঐতিহাসিক স্থানে একটি ভিউ পয়েন্ট আছে যেখান থেকে আপনি দুর্দান্ত গোলাপের বাগানের দৃশ্যে উপভোগ করতে পারবেন।

দার-উল-বাহার অতীতে একটি বিশ্রামাগার হিসাবে বিবেচিত হত, তবে এখন এটি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ইউনিট হয়েছে। এই ঐতিহাসিক জায়গাটি সকাল ১০:০০ টা থেকে বিকাল ৫:০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে ও আপনি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রবেশ করতে পারেন।

খ্রিস্ট চার্চ

খ্রিস্ট চার্চ

বর্ধমানে একটা ছোট কিন্তু ভীষণ সুন্দর ও অত্যন্ত জনপ্রিয় চার্চ আছে ঠিক কার্জনগেট আর হেড পোস্ট অফিসের মাঝে। এটি পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রাচীনতম গির্জা। অষ্টাদশ শতকে বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা হবার পরে, কোলকাতার বাইরে অন্যান্য জেলাতেও খ্রিস্টান মিশনারিরা ছড়িয়ে পড়েন। সেই সূত্রে গড়ে ওঠে অনেকগুলো চার্চ, যার মধ্যে বর্ধমান সদরে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন চার্লস স্টুয়ার্ট ১৮১৬ সালে এই প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জার নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করেন। ক্যাপ্টেনের তত্ত্বাবধানে তৎকালীন বর্ধমানের রাজার থেকে চার্চের জন্য জমিটি লিজ নেন বাৎসরিক ১২.৫০ টাকা খাজনায়। তবে এই ঐতিহাসিক গির্জাটিকে সত্যই সু-রক্ষণাবেক্ষণ করায় এখনও চমৎকার অবস্থায় সংরক্ষিত আছে।

আসলে এই গির্জার নকশা এবং স্থাপত্য এটিকে এতদ অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গির্জা করে তুলেছে। এটি ঐতিহ্যবাহী ইউরোপীয় শৈলীতে নির্মিত হয়েছে। গির্জার একদিকে একটি অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ এবং অন্যদিকে একটি পোর্টিকো রয়েছে। অর্ধবৃত্তাকার গির্জার সামনের অংশটি একটি সূক্ষ্ম পেডিমেন্ট এবং একটি ক্রুশ দ্বারা আবৃত। চার্চটির সামনে একটি বেল টাওয়ারে একটি বিশাল লোহার ঘণ্টা রয়েছে যা প্রধান প্রবেশপথের উপরে ঝুলছে। প্রেয়ার হল ঘরটি ছোট। এখানে কোনো মূর্তি পূজা করা হয় না।

আপনি যদি কোলকাতা থেকে বেড়ানোর কথা ভাবছেন তবে পূর্ব বর্ধমানের এই শহরের এই সুন্দর জায়গাগুলি আপনার জন্য উপযুক্ত।

বর্ধমান ১০৮ শিব মন্দির

বর্ধমান ১০৮ শিব মন্দির

বর্ধমান ১০৮ শিব মন্দির বর্ধমানের নবাবহাট বাস স্ট্যান্ডে একদম পাশেই অবস্থিত । এটি বর্ধমান স্টেশন থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরে। এই শিব মন্দির কমপ্লেক্স একটি উল্লেখযোগ্য তীর্থস্থান যা সারা বিশ্ব থেকে মানুষকে আকর্ষণ করে। এই মন্দির কমপ্লেক্স কে বর্ধমান ১০৮ শিব মন্দির বলা হলেও আসলে এখানে আছে ১০৯ টি শিব মন্দির। ১০৮ টি পাশাপাশি সারিবদ্ধ ভাবে এবং একটি মন্দির একদম আলাদা জায়গায় তৈরি। মন্দির গুলোকে ওপরে থেকে দেখলে একেবারে জপমালার মত দেখায়।

সারা বিশ্বে যদি খোঁজ করা হয় তাহলে দুটি ১০৮ শিবমন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। আশ্চর্য্যজনক ভাবে এই দুটি ১০৮ শিবমন্দিরই অবস্থিত এই পূর্ব বর্ধমান জেলায়। এই দুটি মন্দিরের নির্মাণের সাথে বর্ধমান রাজবাড়ি যুক্ত ছিল। একটি অম্বিকা কালনা শহরে এবং অপরটি বর্ধমান শহরের কাছেই নবাবহাটে। পূর্ব বর্ধমান জেলার এই দুটি শিব মন্দিরের খ্যাতি কিন্তু ভারত জুড়ে, আমাদের রাজ্যের পাশাপাশি বাইরের রাজ্যে থেকেও দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে এই দুই মন্দিরে।

কালনা ১০৮ শিব মন্দির নিয়ে লেখা একটি তথ্য সমৃদ্ধ ব্লগ পড়তে পারেন এখানে।

সর্বমঙ্গলা মন্দির

সর্বমঙ্গলা মন্দির

বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দির দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম পীঠস্থান। এখানে দেবী সর্বমঙ্গলারূপে পূজিতা হন। প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যক ভক্তরা আসেন এই মন্দিরে। দেবী দুর্গা বা সর্বমঙ্গলা এই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ৷

১৭০২ সালে টেরাকোটার নিপুণ কারুকার্য করে সর্বমঙ্গলা মন্দির নির্মাণ করেন মহারাজাধিরাজ কীর্তিচাঁদ মহতাব। এই দেবী সর্বমঙ্গলার  হাত ধরে দুর্গাপুজো  জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বর্ধমান জেলা জুড়ে। কষ্টিপাথরের অষ্টাদশভুজা। সিংহবাহিনী দুর্গাই পুজিত হন সর্বমঙ্গলা রূপে। তিনশো পয়ষট্টি দিনই সর্বমঙ্গলা মন্দিরে হয় রাজকীয় আয়োজন। রাজবেশ ও দামী গয়নায় সাজিয়ে তোলা হয় সর্বমঙ্গলাকে। বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা দেবী মন্দির পোড়ামাটির তৈরী স্থ্যাপত্যের এক অপূর্ব উদাহরণ। এই মন্দিরে দেখতে পাবেন তৎকালীন বাংলায় নবরত্ন স্থাপত্যের এক অসাধারণ শৈলী।

দেবী দুর্গার মূর্তি মূল্যবান কষ্টিপাথর দিয়ে তৈরি। তিনি মহিষমর্দিনী বা সিংহবাহিনী নামে পরিচিত। স্বয়ং রামকৃষ্ণ এই মন্দিরে এসেছেন বলে কথিত আছে।

চুপির চর

চুপির চর

চুপির চর মানে পূর্ব বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী পাখীরালয়কে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী পাখিদের স্বর্গরাজ্য বলা যেতে পারে। পূর্বস্থলীতে ভাগীরথী নদী সৃষ্ট এই চরের আরেক নাম চুপির চর। শীত পড়ার সাথে সাথেই এই চর এলাকায় প্রচুর পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা হয়। যার টানে পর্যটক থেকে শুরু করে পাখি বিশেষজ্ঞ এবং ফটোগ্রাফারদের আনাগোনা বেশ বেড়ে যায় শীত পড়লেই।

আপনি যদি পাখি প্রেমী বা ফটোগ্রাফি করতে ভালোবাসেন তাহলে আসতেই পারেন এই চুপির চরে, এখানে আসা একদমই কঠিন কাজ না, কাটোয়া লোকাল ধরে আপনাকে নামতে হবে পূর্বস্থলী স্টেশনে। একটা দিন কখন চোখের নিমেষে কেটে যাবে বুঝতেই পারবেননা।

চুপির চর বা পূর্বস্থলী সম্পর্কে পুর্ন বিবরন জানুন এখানে।

সাত দেউল

সাত দেউল

সাত দেউল জায়গাটি বিখ্যাত একটি সহস্র বর্ষাধিক প্রাচীন জৈন মন্দিরের জন্য। নবম শতকে নির্মিত এই জৈন দেবালয়টি সম্ভবত কোন তীর্থঙ্করের উদ্দেশ্যে অর্পিত হয়েছিল। সাত দেউলের উপরিভাগে একখণ্ড প্রস্তরের উপর ১৪১ টি তীর্থঙ্করের মূর্তি খোদিত আছে। যার ঊর্ববভাগে উপবিষ্ট আছেন বৃষভবাহন সহ স্বয়ং ঋষভ নাথ। খোদিত প্রস্তর খন্ডটি বর্তমানে সরকারি মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। কথিত আছে পালযুগের রাজা শালিবাহন এই দেউল নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরটির ভিত পঞ্চরত্ন স্থাপত্য শৈলিতে তৈরি। প্রবেশদ্বারের ওপরে, বাইরের দেওয়ালে রয়েছে সুন্দর কারুকার্য করা চৈত্য-জানালা। দেউলের ভিতরে কোনও বিগ্রহ বা মূর্তি নেই।

শোনা যায় অতীতে এখানে ৭ টি দেউল ছিল, সেকারণে স্থাননাম হয়েছিল সাতদেউলিয়া। বর্তমানে একটিমাত্র দেউল অবশিষ্ট আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই স্থানের বাসিন্দারা প্রায় সকলেই মুসলমান, কিন্তু মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণর ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার সীমা নেই।

বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ থেকে দেউলটি ভালভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ফুলের গাছপালা লাগিয়ে , বাহারি গাছ ছেঁটে এবং ইটের সারি দিয়ে সুন্দর ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। গেট থেকে দেউল পর্যন্ত সুরকি বিছানো সুন্দর পথ ও তৈরি করা হয়েছে। একটা দিন বেড়িয়ে আসার পক্ষে এলাকাটি খুবই উপযোগী।

কিভাবে যাবেন সাত দেউল

একদিনের ছোট্ট আউটিংয়ের আদর্শ স্থান এই সাত দেউল। বর্ধমান থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আঝাপুর। কলকাতা ও বর্ধমান থেকে বাস ও ট্রেনের যোগাযোগ খুবই ভালো। সকাল সকাল ঘর থেকে বেরিয়ে হাওড়া বা শিয়ালদা থেকে বর্ধমানের লোকাল ট্রেনে উঠুন। মেমারি স্টেশনে নেমে টোটোতে উঠুন আর মাত্র মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে যাবেন সাত দেউল।


Leave a Comment