জলপাইগুড়ি জেলার দর্শনীয় স্থান খোঁজা খুব একটা কষ্টের নয় কারন পশ্চিমবঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলার মতো খুব কমই জেলা আছে যা সম্ভবত পর্যটনে এতটা সমৃদ্ধ। অবাক করা খাড়া গিরিখাত, বিস্তীর্ণ অশান্ত নদী, ঘন সবুজ বনাঞ্চল, চা এস্টেটগুলির ঢেউখেলানো ব্যাপ্তি সাথে হিমালয় পর্বতের অসাধারন সৌন্দর্য। এখানে বন্যপ্রান সংরক্ষনের জন্য বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান সব মিলে পর্যটকদের কাছে এক সবপেয়েছির জেলা হল এই জলপাইগুড়ি।
জলপাইগুড়ি জেলার দর্শনীয় স্থান, সেরা ৮টি কোনগুলি?
1. গোরুমারা জাতীয় উদ্যান
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত গোরুমারা জাতীয় উদ্যান জলপাইগুড়ি জেলার একটি জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য। এই জাতীয় উদ্যানটি ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে প্রধানত একশৃঙ্গ ভারতীয় গন্ডারের জন্য পরিচিত। উদ্যানটির নৈস্বর্গিক দৃশ্য আপনার মনকে ছুঁয়ে যাবেই। গোরুমারা উদ্যানের ভিতর দিয়ে রায়ডাক, জলঢাকা ও মূর্তি নদী সম্মিলিত ভাবে এই অরন্যকে পুষ্ট করেছে। ফলে বেড়ে উঠেছে অসংখ্য সাধারণ উদ্ভিদ, ছোট ও বড় গাছের দল এবং বন্য পরিবেশ পার্কটির শোভা বাড়িয়েছে। এর নয়নাভিরাম দৃশ্য বোঝাযায় যখন আপনি এই জাতীয় উদ্যান ঘিরে ছোট ছোট গ্রামগুলি যেমন বুধুরাম, চৌতুরাম, বিছাভাঙ্গা বা মুর্তি যদি দেখেন।
বন্যপ্রাণী দেখার সর্বোত্তম উপায় হল জিপ সাফারির মাধ্যমে বা আপনি এই বন্য পরিবেশ উপভোগ করতে পারেন এখানে বসবাসকারী বন্য শুয়োর, পিগমি হগ, বড়ো কাঠবিড়ালি, চিতল হরিণ, কাঠঠোকরা, সম্বর হরিণ ছাড়াও ভারতীয় নেকড়ে চোখে পড়তে পারে। গোরুমারা উদ্যানের ভিতর কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে যেখান থেকে সুন্দর ভাবে চারিদিকের দারুন ভিউ পাবেন।
2. জল্পেশ মন্দির
জলপাইগুড়ি শহরের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে এই অঞ্চলের অন্যতম মন্দির হল জল্পেশ মন্দির, এমন একটি স্থান যা পরিদর্শন করা উচিৎ। মন্দিরটি ভ্রামরী শক্তিপীঠের ভৈরবকে ‘জল্পেশ’ হিসাবে উৎসর্গ করা হয়েছে। জল্পেশ হচ্ছে শিবের একটি রূপ। মন্দিরের অভ্যন্তরে জটিল কাঠামো, নির্মল আভা এবং শিবলিঙ্গ যাকে বলা হয় ‘অনাদি’ তাৎক্ষণিকভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করে।
বিশেষ করে মহাশিবরাত্রির সময় (ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ এবং জুলাই থেকে আগস্ট) মন্দিরগুলির পরিবেশ একেবারে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এছাড়াও, শ্রাবণ মাসে অনুষ্ঠিত শ্রাবণী মেলার জন্যও এখানে প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে।
3. মূর্তি
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে মুর্তি নদীর ওপর ছবির মত সুন্দর ছোট্ট একটি গ্রাম। মূর্তি গ্রামটির নামকরণ করা হয়েছে সুন্দর নদীর নাম থেকে। মুর্তি নদী এই গ্রাম হয়ে নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে। মুর্তি নদী পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম এবং ভুটানের সীমান্ত সংযোগের কাছে উৎপন্ন হয় এবং পাহাড়ি উপত্যকা থেকে স্যামসিং অঞ্চলের ঘুরে একেবারে ডুয়ার্সে পড়েছে। গোরুমারা জাতীয় উদ্যান বা চাপড়ামারী অভয়ারন্য উভয় অঞ্চলে ঘোরার সময় মুর্তি গ্রাম হোমস্টে বা রাত্রিবাসের জন্য আদর্শ জায়গা।
মূর্তি গ্রাম যেমন ছবির মত সুন্দর তেমনই নির্মল। প্রকৃতি যেন তার বিশুদ্ধতম রূপে নিজেকে সাজিয়ে এখানে। মূর্তি নদীর জল এখানে যেমন দুষনমুক্ত, পারিপার্শিক গাছপালা ততটাই ঘন সবুজ। জলপাইগুড়ি জেলার দর্শনীয় স্থান হিসাবে মুর্তি গ্রামের একটি বিশেষ জায়গা রয়েছে। বছরের বেশির ভাগ সময়ে মুর্তি নদী আপনি খালি পায়ে পারাপার করতে পারবেন। এর পাড় বরাবর হাঁটা আপনার স্মৃতিতে জায়গা করে নেবেই। শুধু বর্ষাকালে চেহারা একটু অন্যরকম, অনেক চওড়া হয়ে যায় আর জল সবকিছু ধুয়ে নিয়ে যায়।
4. জলপাইগুড়ি রাজবাড়ি
জলপাইগুড়ি রাজবাড়ি হল বৈকুণ্ঠপুর এস্টেটের স্থানীয় শাসকদের রাজকীয় রায়কুট পরিবারের প্রাক্তন বাসভবন। এই ঐতিহাসিক স্থানে একটি প্রাসাদ ভবন, একটি পোর্টিকো এবং দুটি মন্দির রয়েছে যা দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। স্থানীয় ইতিহাস জানতে, এই রাজবাড়ী, জলপাইগুড়ি জেলার দর্শনীয় স্থান হিসাবে অগ্রগন্য। এছাড়াও, একটি পুকুর দ্বারা ঘেরা সবুজ বাগান যাদুকরীভাবে এর আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে।
জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির বিশাল ফটকটি একটি স্থাপত্যের বিস্ময় এবং এটি একটি অ-শক্তিশালী কংক্রিটের খিলানের বৃহত্তম কাঠামোগুলির মধ্যে একটি। প্রাসাদটি অন্বেষণ করার পরে, আপনি বাগানে আরাম করতে পারেন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রশংসা করতে পারেন।
5. সামসিং
সামসিং জলপাইগুড়ি জেলায় প্রায় 3000 ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি অত্যন্ত সুন্দর গ্রাম। সামসিং প্রায় দার্জিলিং জেলার সীমানা ঘেঁষে রয়েছে ফলে এটি নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশদ্বার হিসাবেও কাজ করে। পাহাড়, সমতল, নদী, বন এবং চা বাগানের এক দারুন মিশ্রণ এই অঞ্চলটি বৈশিষ্ট। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে ভুলোকে এক স্বর্গীয় দর্শন দেবে। জায়গাটি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এবং বেশ নির্মল। সামসিং-এর একদিকে বিশাল পাহাড়ের ঋষিসুলভ গাম্ভীর্য এবং অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত শান্ত সমতল সবুজ তৃণভূমি, এই বৈপরীত্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
সাম্প্রতিক কালে, স্যামসিং আরও বেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে যারা গন্তব্যের কেবল মনোরম নয়, সাথে শান্তিপূর্ণ এবং নির্মল পরিবেশও প্রদান করে। কৃষি পর্যটন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, দর্শনার্থীরা চা চাষ এবং চা বাগানের শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবন বোঝার এবং অনুভব করতে গভীর আগ্রহ দেখাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে, স্যামসিং একটি দারুন উদাহরণ যে কীভাবে দূরবর্তী এবং কম পরিচিত গন্তব্যগুলি ভ্রমণ শিল্পে একটি বিশেষ স্থান তৈরি করতে পারে। স্থানীয় সংস্কৃতির উষ্ণতার সাথে প্রকৃতির সৌন্দর্য সমবেত ভাবে, সামসিং একটি পর্যটনের মডেল হওয়ার পথে।
সামসিং-এ গ্রীষ্মকাল দারুন মনোরম তবে এখানে বেড়াবার সবচেয়ে ভাল সময় হল অক্টোবর থেকে মার্চ মাস, যখন পাহাড়ের চারপাশের সবুজ ও সোনালী দৃশ্যে ভরা থাকে।
6. জটিলেশ্বর মন্দির
ডুয়ার্স অঞ্চলের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি হল এই জটিলেশ্বর মন্দির। এটি জলপাইগুড়ি শহর থেকে প্রায় 30 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ৩২০ থেকে ৬০০ খৃস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত এই মন্দিরটি বিশাল ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। মন্দিরটি বাবা জটিলেশ্বর বা ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত।
দর্শনার্থীদের তাত্ক্ষণিক আত্মার তৃপ্তি ও প্রানশক্তি প্রদান করে এই মন্দিরের বিশাল প্রাঙ্গণ যা নানা রকম গাছগাছালিতে পরিপুর্ন। এছাড়া মন্দির চত্বরে আপনি দুটি জলাশয় দেখতে পাবেন। আপনি স্থানটির নিছক প্রশান্তি আবিষ্ট করতে, জলপাইগুড়িতে এসে প্রথমেই পরিদর্শনের পরিকল্পনা করতে পারেন।
7. চাপড়ামারী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
চাপড়ামারী জলপাইগুড়ির অন্যতম প্রাচীন অরণ্য এবং জলপাইগুড়ি জেলার দর্শনীয় স্থান। বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের বাসস্থান হওয়ায় এই বনভূমিকে ১৮৯৫ সালে প্রথম ফরেস্ট রিজার্ভ হিসাবে ঘোষনা করা হয়। চাপড়ামারী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য আসলে গোরুমারা জাতীয় উদ্যানের বর্ধিত একটি অংশ । বলাযায় মুর্তি নদী এই দুটি বনকে আলাদা করে দিয়েছে।
চাপড়ামারী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে বিভিন্ন পশু যেমন হাতি, চিতাবাঘ, বাইসন, হরিণ, স্কারলেট, মিনিভেট, ডার্টার, বন্য হাঁসের বাসস্থান। এছাড়াও আপনি চাপড়ামারীতে বছরের বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য রকমের অর্কিড ফুল দেখতে পারেন। যেটা না করলে আপনার ভ্রমণ অসম্পুর্ন থাকবে তা হল চাপড়ামারীতে ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে পুরো জঙ্গলের চারিদিকে অপুর্ব দৃশ্য দেখা এবং অবশ্যই জিপ সাফারির করে অভয়ারন্যের ভিতরে বন্যপ্রানী দেখা।
8. বিন্দু
বিন্দু হল জলপাইগুড়ি জেলায় ভুটান সীমান্তের কাছে, জলঢাকা নদী এবং বিন্দু খোলার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম। হিমালয়ের কোলে এই গ্রামটির মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং শান্ত পরিবেশের জন্য আদৃত। এখানকার এলাচ বাগান গুলি দেখার মত।
বিন্দু ভ্রমণের সবচেয়ে ভাল সময় হল অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস। এই সময়ে অর্থাৎ বর্ষা-পরবর্তী এবং শীতকালীন ঋতুতে যখন আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে শুষ্ক এবং তাপমাত্রা মনোরম থাকে, যেটা বিন্দু’কে আরও দর্শনীয় স্থান এবং আউটডোর এক্টিভিটির জন্য আদর্শ করে তোলে। এই সময়ের আকাশ সাধারণত পরিষ্কার থাকে, হিমালয়ের পাদদেশ এবং সবুজ চা বাগান সহ সুন্দর ল্যান্ডস্কেপের বাধাহীন দৃশ্য পর্যটকদের আকর্ষিত করে।
পর্যটকরা এখানকার হোমস্টে এবং পরিবেশ বান্ধব রিসর্টে থাকতে পছন্দ করে যা তাদের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয় জীবনধারা বোঝার একটি সুযোগ দেয়। এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের সাথে, বিন্দু, পাখি পর্যবেক্ষক এবং প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটি হটস্পট হয়ে উঠেছে যারা সবুজ বনের মধ্য দিয়ে গাইডেড হাঁটা উপভোগ করে। পর্যটকরা নদী পারাপার, ট্রেকিং ইত্যাদি অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণ এবং মাছ ধরার মতো ক্রিয়াকলাপগুলি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যা এই মনোরম গ্রামটিতে অ্যাডভেঞ্চার উত্সাহীদের আকর্ষণ করে৷
উপরে জলপাইগুড়ি জেলার কিছু বিখ্যাত স্থানের কথা বলা হল। তবে যদি অনেক প্রস্তুতি নিয়ে আসেন বা হঠাৎ আগত হন, আপনার চোখ সদা সর্বদা আপনার মনকে নতুন আনন্দ ও প্রশান্তি প্রদান করেতেই থাকবে। যদি কোনও পর্যটক প্রকৃতিপ্রেমী বা বন্যজীবনের একজন অনুরাগী হয় তবে তিনি সম্ভবত জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবেন। আর হ্যাঁ, আপনি যদি বন্যপ্রাণীর ছবি নিতে ভালোবাসেন, তাহলে জলপাইগুড়ি জেলা হল অন্যতম সেরা জায়গা। তাই সামনের ছুটিতে আপনার ব্যাগ বাঁধুন জলপাইগুড়ি জেলা ভ্রমণের জন্য।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷