বড়ন্তি পুরুলিয়া জেলায় ভ্রমণ উপযোগি খুব সুন্দর একটি গ্রাম যেটি প্রতি ঋতুতে নতুন রঙে সেজে ওঠে। অল্প কয়েকটা পরিবার, বেশ ঘন জঙ্গল, একটা দারুন সুন্দর হ্রদ আর হ্রদের ধারেই ছোট্ট পাহাড়, মানে স্বর্গ রচনায় যা যা উপকরন লাগে তা সবই একসাথে এখানে রয়েছে – এটাই বড়ন্তি। ঘন সবুজ পাহাড়, বর্ষার পর গেলে অনেক নতুন ঝর্না আর চারিদিকে শুধু শাল, সেগুন, পলাশ ও মহুয়ার জঙ্গল। বুক ভরে শুদ্ধ বাতাস নিন আর শরীর ও মনকে আরও সতেজ করে তুলুন।
কিভাবে পৌছাবেন বড়ন্তি
- ট্রেনে: কলকাতা থেকে ট্রেনে বড়ন্তি আসার একটি উপায় হল আপনি হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে আসানসোলের যেকোনো ট্রেন ধরে আসানসোল আসুন। তারপরে আসানসোল থেকে মুরাদি যাওয়ার জন্য আরেকটি ট্রেন ধরুন। মুরাদি থেকে বরন্তি ৬ কিমি মাত্র তাই ওখান থেকে একটি গাড়ী বা রিকশা নিয়ে পৌছে যেতে পারেন।
বিকল্প আরেকটি উপায় হল আপনি হাওড়া থেকে আদ্রা পর্য্যন্ত ট্রেনে (প্রায় ৯-১০টা ট্রেন আছে) আসুন, তারপরে আদ্রা থেকে মুরাদি যাওয়ার জন্য আদ্রা-আসানসোল বা বোকারো-আসানসোল যেকোন একটা ট্রেন ধরে নিন। - বাসে: কলকাতার ধর্মতলা বা করুণাময়ী থেকে ভলভো, সিএসটিসি, ডবলু বিএসটিসি বাসে করে আসানসোল পর্যন্ত আসুন। তারপর আসানসোল থেকে আদ্রা লাইনে তিনটি স্টেশন পরেই মুরাডি স্টেশন। মুরাডি স্টেশন থেকে ৬ কিমি দূরে বরন্তি গাড়িতে করে যেতে হবে। আসানসোল ৩৮কিমি সরাসরি গাড়িতে বরন্তি পৌছে যান।
- গাড়িতে: কলকাতা থেকে গাড়িতে আপনি দূর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে দুর্গাপুর শহর পেরিয়ে পাঞ্জাব মোড়ে পৌঁছান। দুর্গাপুর থেকে আসানসোল হয়ে পুরানো জিটি রোড ধরে নিয়মতপুর। নিয়মতপুর থেকে বাঁদিকে দিসেরগড় ব্রীজ পেরিয়ে – বরাকর-পুরুলিয়া রোডে শবরি মোড় থেকে রঘুনাথপুরের দিকে সুভাষ মোড়। মূল রাস্তা থেকে একটি রাস্তা বাঁদিকের রাস্তা ধরে মুরাড়ি।
বড়ন্তি’তে থাকার জায়গা
অন্তত ১০টি বা তার বেশি হোটেল বা রিসর্ট আছে বড়ন্তিতে তার বেশিরভাগই লেকের পাশেই। আপনার পছন্দ ও বাজেট অনুযায়ি যেকোন একটিতে চেক-ইন করতে পারেন। তবে মোটামুটি মাথাপিছু/প্রতিদিন ১৫০০ টাকা থেকে ৬০০০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। নিচে একটা বেক্তিগত অনুমান দিলাম রিসর্টগুলির যদিও আরও অসংখ্য ভাল থাকার জায়গা রয়েছে বড়ন্তিতে।
আপার রেঞ্জ – আরণ্যক রিসোর্ট অ্যালবাম, ইকোলজিক্যাল নেচার রিসোর্ট
মিড রেঞ্জ – স্প্যাঙ্গল উইংস রিসোর্ট
বাজেট রেঞ্জ – লেক ভিউ রিসোর্ট বা আঁখাইবাড়ি রিসোর্ট
কি কি দেখবেন বড়ন্তি গিয়ে
বড়ন্তি পাহাড়, মুরাডি লেক এবং স্থানীয় সরল সুন্দর মানুষের জীবনযাত্রা ও উৎসব এখানকার মুল আকর্ষণ।
বড়ন্তি পাহাড়
বড়ন্তি পাহাড়ে সূর্যাস্ত দেখা হল প্রকৃতিপ্রেমী, হাইকার কিংবা ট্রেকারদের জন্য একটি আকর্ষনিয় জায়গা। যারা গ্রামাঞ্চলের সৌন্দর্য এবং আনন্দ খুঁজতে চান তাঁরা এসবকিছু পেতে পারেন এই বড়ন্তি পাহাড় ও আরেকটি পাহাড়ে ঘেরা একটা ছোট্ট ছবির মত গ্রাম দেখতে পারেন।
পাহাড়টি সবুজ চাদরে ঢাকা থাকে বিশেষত বর্ষা পরবর্তি সময়ে এবং বহু রকমের প্রানের, যেমন প্রজাপতি, পাখি, শেয়াল, খরগোশ, সজারু, বুনশুয়র ইত্যাদির আশ্রয়স্থলও বটে। প্রতি বছর বহু বন্যপশু প্রেমী এই অঞ্চলে ভ্রমনে আসেন।
বড়ন্তি লেক
বড়ন্তি লেক বা মুরাডি ড্যাম হল রামচন্দ্রপুর সেচ প্রকল্পের অন্তর্গত একটি জলাধার যার পোশাকি নাম রামচন্দ্রপুর জলাধার। কিন্তু সাধারন লোকে বড়ন্তি লেক নামেই বেশি চেনে। বড়ন্তি নদীতে বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছিল অতীব সুন্দর এই জলাধারটি। হ্রদটি মনোরম এবং অনেক পাখি, প্রজাপতি এবং প্রাণীকেও এটি আকর্ষণ করে। মাছ ধরা, বোটিং এবং পিকনিক করার জন্য এটি একটি বিখ্যাত স্থান।
বড়ন্তি লেকে যেমন সুর্যোদয়ের সময় ছোট জেলে নৌকাগুলিকে উদীয়মান সূর্যের পটভূমিতে ভীষণ সুন্দর দেখায়। তেমনি হ্রদটি সূর্যাস্তের সময় লাল রঙের একটি মনোরম দৃশ্য তৈরি হয় সাথে জলের উপর বড়ন্তি পাহাড়ের প্রতিফলন সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য এই জায়গাটিকে পুরুলিয়ার একটি বিখ্যাত আকর্ষণ করে তুলেছে।
স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রা ও তাদের উৎসব
জীবনপুর গ্রামের রাস্তায় যদি একটু সময় নিয়ে ঘুরতে বের হন দেখবেন হাঁটতে হাঁটতেই আলাপ হয়ে যাবে সহজ-সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত গ্রামবাসীদের সঙ্গে। (ওরাই কথায় কথায় জানিয়ে দেয়,) স্থানীয় বাসিন্দারা কার্তিক মাসে বাঁধনা পরব‘র সময় মারাং-বুরু (তাদের দেবতা) পুজো করেন। আবার মাঘ মাসের পরবে ধানসিং-মানসিং এর পুজো করেন। ছবির মত ওদের গ্রামের ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বড়ন্তি নদী। এই নদীর ওপরই বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে বড়ন্তি লেক। জীবনপুর গ্রামে কাটানো সময় আপনার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বড়ন্তি থেকে কয়েক ঘন্টার জন্য গাড়ি নিয়ে জীবনপুর গ্রাম দেখার পর, যেতে পারেন আরও এক সুন্দর গ্রাম মানজুড়িতে। সাঁওতালদের এই গ্রামটি বেশ বড়। মাটির দেওয়ালে সুন্দর আলপনার কারুকার্য। দারুণ ভাবে নিকোনো বারান্দা। এ সবই শহুরে অতিথিদের বেশ আকৃষ্ট করে। লাল মাটির এই সুন্দর রাস্তা তালবেড়িয়া হয়ে পোরেলি গ্রামের দিকে। অজস্র পুকুর তাতে ফুটে রয়েছে শালুক বা শাপলা, সেখানে দলে দলে হাঁসেরা ঘুরছে মানুষের গায়ের কাছে। এই গ্রামের পাশেই পোরোলি পাহাড়। পোরোলি পেরিয়ে মুরাডি হয়ে ফিরে আসুন আপনার হটেলে।
কি কি করতে পারেন বড়ন্তিতে
বড়ন্তি খুব একটা উঁচু পাহাড়ের পর্যায়ে পড়ে না, তবে এই পাহাড়ের গায়ে ঘন জঙ্গলে হাঁটা বা ট্রেক করার মধ্যে বেশ একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার আছে। ভোরবেলায় লেকের পাশে হাঁটুন শরীর ও মন দুই ভাল হবে। বিকেলবেলায় সূর্যাস্ত দেখা সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। ফাঁকা লাল মাটির রাস্তার ওপর হেঁটে যেতে যেতে কানে পাখির কোলাহল মন আনন্দে নেচে উঠবে। তবে সূর্যাস্তের পর কিন্তু লেকের কাছে না থাকাই ভাল। পুরপুরি অন্ধকার নামার আগেই হটেলে ফিরে আসুন।
বড়ন্তি পুরুলিয়া ভ্রমণের আদর্শ সময়
জায়গাটিতে সারা বছরই আসা যায় এই রূপসী বড়ন্তি লেকের সৌন্দর্য ও পাহাড়ি জঙ্গল উপভোগ করা যায়। আর ফেব্রুয়ারী মাস নাগাদ এখানকার সমগ্র বরন্তির বন লালে লাল হয়ে ওঠে। তাই অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সব থেকে মনোরম পরিবেশ থাকে। কারন তাপমাত্রা কম থাকে।
জুলাই এবং আগস্ট মাসে আপনি পাখির কিচিরমিচির অনুভব করতে পারেন। বর্ষার ভারী বৃষ্টির জলে বনের গাছপালা সবথেকে সবুজ ও সুন্দর হয়ে ওঠে। এই সময় এই লেক, পাহাড় আর ছোট ছোট ঝর্নাগুলে একত্রে প্রকৃতিকে মোহময় করে তোলে।
আশেপাশে আরও কি কি দেখতে পারেন
বড়ন্তি থেকে যেখানে যাবেন | বড়ন্তি থেকে তার দুরত্ব |
গড়পঞ্চকোট | ১২ কিলোমিটার |
বিহারীনাথ মন্দির | ২০ কিলোমিটার |
জয়চন্ডী পাহাড় | ২১ কিলোমিটার |
পাঞ্চেত বাঁধ | ২২ কিলোমিটার |
মাইথন বাঁধ | ৩৯ কিলোমিটার |
কল্যাণেশ্বরী মন্দির | ৪০ কিলোমিটার |
শুশুনিয়া পাহাড় | ৪২ কিলোমিটার |
আরও পড়ুনঃ পুরুলিয়া আযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখাটি।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷
বেশ ভালো লেখা 🙂