আলিপুরদুয়ার জেলার সেরা ৬টি দর্শনীয় স্থান – পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণ

আলিপুরদুয়ার জেলার দর্শনীয় স্থান

আলিপুরদুয়ার জেলার দর্শনীয় স্থান বলতে বক্সা, জলদাপাড়া বা জয়ন্তি সবই পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। আলিপুরদুয়ার জেলা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর প্রান্তে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত। এই অঞ্চল ভুটান তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার বলা যেতে পারে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপুর্ন এই জেলায় বহু দর্শনীয় স্থান বা পর্যটন গন্তব্য রয়েছে। এই দর্শনীয় স্থানগুলিতে সারা বছরই বহু পর্যটক আসেন। জেলার বেশির ভাগ অংশ ঘন বনাঞ্চল দ্বারা আবৃত। এই বনাঞ্চল হল ভারতীয় গণ্ডার ও হাতির প্রধান বাসভূমি। এছাড়া এখানে বাঘ, হরিণ, বাইসন, পাখি এবং বিভিন্ন সরীসৃপের বাস।

আলিপুরদুয়ার জেলার দর্শনীয় স্থান কোনগুলি?


1. বক্সা জাতীয় উদ্যান ও টাইগার রিজার্ভ

বক্সা জাতীয় উদ্যান
Picture credit : aryango.com

আলিপুরদুয়ার জেলায় বক্সা পাহাড় অঞ্চলে বক্সা জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। বক্সা টাইগার রিজার্ভ একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটক গন্তব্য। প্রায় সাড়ে সাতশ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে এই টাইগার রিজার্ভ ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯২ সালে একটি জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এই উদ্যানে বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রানী যেমন চীনা প্যাঙ্গোলিন, রিগাল পাইথন এবং ক্লাউডেড চিতাবাঘ, সিভেট ও রেড জঙ্গল ফাউল দেখা যায়। বক্সা টাইগার রিজার্ভ ভুটান এবং ভারত থেকে হাতিদের অভিবাসনের জন্য একটি আন্তর্জাতিক দরজা হিসেবে কাজ করে। এখানে শীতকালে প্রচুর পরিযায়ী পাখিদের আগমন হয়। বক্সা জাতীয় উদ্যান যেহেতু এখানকার পর্বতকে ঘিরে রয়েছে তাই উদ্যানের দিগন্ত বিস্তৃত সৌন্দর্য অপুর্ব।

এই উদ্যানের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন একটি দুর্গ যেটি বক্সা ফোর্ট নামে পরিচিত। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ইংরেজরা দুর্গটি উচ্চ নিরাপত্তাযুক্ত কারাগার ও ডিটেনশন ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করত। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এই দুর্গে মোট ৫২৫ জনকে বন্দী রাখা হয়। বক্সা টাইগার রিজার্ভের মধ্যে ট্রেকিং করে বক্সা দুর্গে যাওয়া যায়। বক্সা জাতীয় উদ্যান এবং বক্সা ফোর্টের মত ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক এবং দুর্দান্ত সব বন্যপ্রাণীর ছবি তুলতে কিন্তু একদম ভুলবেন না।

ট্রেনে গেলেআপনাকে আলিপুরদুয়ার জং/নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে নামতে হবে।
গাড়িতে গেলেএছাড়াও আপনি শিলিগুড়ি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার থেকে রাজাভাতখাওয়া হয়ে বক্সা টাইগার রিজার্ভে পৌঁছাতে পারেন।

2. জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান

জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান
Picture credit : wbsfda.org

আলিপুরদুয়ার জেলায় হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান যার মধ্যে রয়েছে সাভানা এবং লম্বা ঘাসে আচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ এক তৃণভূমি। তোর্সা এই উদ্যানের প্রধান নদী। এখানকার জীবজন্তুর মধ্যে অবলুপ্তপ্রায় একশৃঙ্গ গণ্ডার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জলদাপাড়ায় পর্যটকদের জন্য এলিফ্যান্ট সাফারির মাধ্যমে জীবজন্তু পরিদর্শনের ব্যবস্থা আছে। এখানে প্রাপ্ত প্রাণীদের মধ্যে বাঘ, হাতি, হরিণ, সম্ভার, বার্কিং ডিয়ার, স্পটেড ডিয়ার, হগ ডিয়ার, বন্য শূকর এবং বাইসন অন্যতম।

জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান প্রচুর পাখিদের বাসস্থানও বটে। এখানে দেখতে পাওয়া পাখিদের মধ্যে বেঙ্গল বাস্তার্ড বিশেষ উল্লেখ্য কারন সারা ভারতে মাত্র কয়েকটি জায়গাতেই দেখা যায়। তার সাথে পাইড হর্নবিল, জঙ্গল ফাউল, ময়ূর, তিতির এবং ক্রেস্টেড ঈগলের এখানে দেখা যায়। খুব সকাল সকাল অভয়ারণ্যের সজীব উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত দেখার জন্য বেশ রোমাঞ্চকর হাতি সাফারির পরিকল্পনা করতে পারেন।

ট্রেনে গেলে আপনাকে হাসিমারা বা আলিপুরদুয়ার জং বা নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে নামতে হবে।
গাড়িতে গেলেশিলিগুড়ি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার থেকেও আপনি জলদাপাড়া পৌঁছতে পারেন।

3. চিলাপাতা বনাঞ্চল

চিলাপাতা
Picture credit : dooars.info

জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান ও বক্সা জাতীয় উদ্যানের মধ্যবর্তী হাতি করিডোর চিলাপাতা একটি ঘন বনভুমি। এটি হাসিমারা শহর থেকে সামান্য দূরে এবং আলিপুরদুয়ার থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই বনে বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু দেখা যায়। এখানে আগে গণ্ডার দেখা যেত। বর্তমানে এখানে চিতাবাঘ দেখা যায়। বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফার এবং অ্যাডভেঞ্চার সন্ধানকারীরা বনের অভ্যন্তরে ট্রেকিং উপভোগ করেন।
রাভা উপজাতির মানুষেরা এই জঙ্গল থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে।

  • পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন পর্ষদের চিলাপাতার কোদালবস্তিতে একটি ইকো-টুরিজম রিসর্ট আছে।
  • মাদারিহাট জলদাপাড়া ট্যুরিস্ট লজ এবং কোদালবস্তি পয়েন্ট থেকে সাফারি নেওয়া যায়।
  • এখানকার প্রধান পর্যটন আকর্ষণ হল নলরাজা গড়। এটি খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত যুগে নির্মিত স্থানীয় নল রাজাদের দুর্গ।
  • এখানে অবসর যাপনের জন্য মাছধরা বা এংলিং এবং বার্ড ওয়াচিং করার বন্দোবস্ত আছে।
  • জীপে করে জঙ্গল সাফারি অবশ্যই ভুলবেন না।

ট্রেনে গেলেকাছাকাছি স্টেশন হাসিমারা চিলাপাতা থেকে প্রায় 10 কিমি দূরে নিকটতম রেল স্টেশন। আলিপুরদুয়ার জং বা নিউ আলিপুরদুয়ার ২৮ কিমি দূরে।
গাড়িতে গেলেআপনি শিলিগুড়ি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার থেকেও চিলাপাতা পৌঁছাতে পারেন।

আরও পড়ুনঃ মধ্যপ্রদেশের সেরা জাতীয় উদ্যান সফর করুন

4. জয়ন্তী

জয়ন্তী
Picture credit : wikimapia.org

আলিপুরদুয়ার শহর থেকে প্রায় থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বক্সা জঙ্গলের ধার ঘেঁষা জয়ন্তীকে বলা হয় ডুয়ার্সের রানি। ভারত-ভূটান সীমান্তবর্তী পাহাড়ে ঘেরা জয়ন্তী ফরেস্ট রেঞ্জ প্রায় ৭৮০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত। জয়ন্তী নদীর ধারে এককালে কোনও গ্রাম ছিল বলে শোনা যায়। বর্তমানে গ্রাম বা বসতি নেই তবে তার অল্প বিস্তর চিহ্ন রয়েছে। জয়ন্তী নদী এখানে শীর্ন তবু সৌন্দর্য্যে এখনও অনন্য।

পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা নুড়ি-পাথরের শুকনো জয়ন্তী নদী, যেটি বছরের বেশিরভাগ সময় শুষ্ক থাকে তবে বর্ষাতে পরিপুর্ন থাকে। চারিদিকে বিরাজমান অপার শান্তি, দুদিকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার একটি উঠেছে ছোট মহাকালের দিকে এবং অন্যটির গন্তব্য বড় মহাকাল মন্দির। একটা কথা না বললেই নয় যে, বনের প্রাকৃতিক দৃশ্য শুধু চোখ মেলে দেখতে এবং স্মৃতি হিসাবে দুর্দান্ত ফটো তুলতে পারেন।

ট্রেনে গেলেআপনাকে আলিপুরদুয়ার জং অথবা নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে নামতে হবে। আলিপুরদুয়ার থেকে জয়ন্তী প্রায় ৩০ কিমি দূরে।
গাড়িতে গেলেআপনি শিলিগুড়ি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার থেকে রাজাভাতখাওয়া হয়ে জয়ন্তীতেও পৌঁছাতে পারেন।

5. রাজাভাতখাওয়া

রাজাভাতখাওয়া
Picture cedit : northbengltourism.com

রাজাভাতখাওয়া হল আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সা টাইগার রিজার্ভের ঠিক বাইরে অবস্থিত একটি ছোট শহর। এটি জয়েন্তি থেকে প্রায় 15 কিমি দূরে। এটি তার প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য পরিচিত, এবং এটি বন দ্বারা বেষ্টিত। আক্ষরিক অর্থে রাজাভাতখাওয়ার অর্থ যেখানে রাজা ভাত খেয়েছিলেন ৷ জনশ্রুতি অনুসারে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ কোচবিহারের রাজা বর্তমান রাজাভাতখাওয়া অঞ্চল থেকে ভুটানের রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করার প্রতিজ্ঞা করে তারপর ভাত খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ কিছু কাল পরে, ভুটানের রাজা নিজেই চলে যেতে রাজি হন এবং বন্ধুত্বের ইঙ্গিত হিসাবে এর পরে রাজাদের মিলন উদযাপন এবং ঘন জঙ্গলে ধানের ভোজের আয়োজন করা হয় এবং এইভাবে স্থানটির নাম রাজাভাতখাওয়া হয়।

আলিপুরদুয়ার জেলাতে অবস্থিত একটি ছোটো জনবসতি৷ এটি সড়কপথে জেলাসদররের সাথে যুক্ত হলেও চারদিক দিয়ে বক্সা জাতীয় উদ্যান দ্বারা পরিবেষ্টিত৷ অঞ্চলটি মনেরম প্রাকৃৃতিক পরিবেশের জন্য জনপ্রিয়৷

পর্যটকরা দের জন্য বন্যপ্রাণী সাফারি, পাখি পর্যবেক্ষণ এবং ট্রেকিং হল অন্যান্য প্রধান কার্যকলাপ।

ট্রেনে গেলেআপনাকে আলিপুরদুয়ার জং অথবা নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে নামতে হবে।
গাড়িতে গেলেএছাড়াও আপনি শিলিগুড়ি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার থেকে রাজাভাতখাওয়া যেতে পারেন।

6. টোটোপাড়া

টোটোপাড়া
Picture credit : dooarstoursandtravels.com

টোটোপাড়া আলিপুরদুয়ার জেলায় ভুটানের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত একটা গ্রামের নাম। গ্রামটি মাদারিহাট থেকে প্রায় ২২ কিমি দূরে অবস্থিত, যা প্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৪১ সালে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষিত বিখ্যাত জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বার। টোটোপাড়া একটি নৃতাত্ত্বিক পর্যটনস্থল বলা হয়। এটি বিশ্বে টোটো উপজাতিদের একমাত্র আবাসস্থল। এ গ্রাম ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথাও এই উপজাতির বসবাস নেই। স্বাধিনতার কয়েক বছর পরেই টোটো উপজাতি ও তাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য এই অঞ্চলটিকে বেছে নেওয়া হয়। বর্তমানে আদমশুমারি অনুযায়ি ওই প্রকল্প সফল হয়েছে এবং বর্তমানে টোটো সম্প্রদায়ভুক্ত লোকজন দাতের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি অনুযায়ি বাস করেন।

গ্রামটির কিছু অংশে ঘোরা যেতে পারে এবং তাদের জীবনযাপন প্রনালি সম্পর্কে ধারনা করা যেতে পারে। নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন যে টোটো সংস্কৃতি এবং ভাষা উপজাতির জন্য সম্পূর্ণ অনন্য, এবং প্রতিবেশী রাজবংশী, কোচ, মেচোর ভুটানি শার্চপ উপজাতিদের থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা।

ট্রেনে গেলেআপনাকে ফালাকাটা অথবা আলিপুরদুয়ার জং অথবা নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে নামতে হবে।
গাড়িতে গেলেশিলিগুড়ি, কোচবিহার, ফালাকাটা এবং আলিপুরদুয়ার থেকেও আপনি টোটোপাড়ায় পৌঁছাতে পারেন।

Leave a Comment