অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগান বাড়ি অর্থাৎ সেই অবন ঠাকুর যাকে আমরা সকলেই জানি শিশুশাহিত্যে তার অবদান বা চিত্রকলায় তার অমর সৃষ্টির জন্য। আজ আমরা অনেকেই হয়ত জানিনা তার ছোট বেলার অনেকাংশ কেটেছে যে বাড়িতে, গঙ্গার পাড়ে তা আজ বয়ে সযত্নে রক্ষিত ‘অবন ঠাকুরের বাগান বাড়ি’। চলুন জেনে নেই কোথায় এবং কিভাবে যাওয়া যায় ইত্যাদি সব তথ্য।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ি কোথায়?
অবন ঠাকুরের বাগান বাড়িটি কলকাতা থেকে উজানে গঙ্গার পশ্চিম পাড় বরাবর বালি ব্রীজ পেরিয়ে কোন্নগর ফেরি ঘাটের কাছেই অবস্থিত। বাগান বাড়ির গেট থেকে শুরু করে ভিতর সব জায়গাতেই একটা সুন্দর ভাল লাগার পরিবেশ রয়েছে। একটু খুলে বলি – মেইন গেট থেকে ঢুকেই একদিকে বেশ একটা বড় দালান অর্থাৎ প্রাচীন শৈলীতে তৈরি বাড়ি রয়েছে, সঙ্গে কিছু অন্যান্য ঘরও রয়েছে যার প্রত্যেকটি সুন্দর ও ছিমছাম সাজানো। অনেকটা ফুলের বাগান এবং গঙ্গার দিকে সুন্দর পুরানো ডিজাইনের পাঁচিল। বাগানের এক দিকে রয়েছে একটি ছোট্ট জলাশয়, শুনলাম এটি অতীতে ছিল স্নানাগার আর এখানেই সাঁতার শিখেছিলেন ছোট্ট অবন।
কয়েক পা চলার পরই সামনে একটি ছোট্ট কুটির তার চারিদিকে শিল্পভাবনার ছোঁয়া স্পষ্ট। ভিতরে ঢুকেই প্রথমে রয়েছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি আবক্ষ মূর্তি। কুটিরের সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে অবনীন্দ্রনাথের শৈল্পিক ভাবনার ছোঁয়া। কোথাও বা পরিত্যক্ত গাছের গুঁড়িকে সুন্দর করে সৌন্দর্যায়নের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। রাস্তার পাশে থাকা বাঁশের ফেন্সিং, বসার জায়গা ইত্যাদি চারিদিকে শান্তিনিকেতনি ভাবনার প্রতিফলন বেশ স্পষ্ট। প্রবাদপ্রতিম চিত্রশিল্পীর যে বাড়ি থেকে আঁকায় হাতেখড়ি হয়েছিল সেই বাড়ির চারিদিকের প্রতি বিন্দুতে যে শিল্পের স্পষ্ট ছোঁয়া থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। সব মিলিয়ে এক কথায় অনবদ্য এই সংরক্ষণ ।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ির সময়
খোলার সময়: | প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত |
প্রবেশ মূল্য: | ১০ টাকা মাথা পিছু। |
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগান বাড়ির ইতিহাস
ঠাকুর পরিবারে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এই বাগান বাড়ির মালিক। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে হলেও এই বাড়িতে তাঁর শৈশবের দীর্ঘ সময় কেটেছে। শুধু তাই নয়, বড় হয়েও তার একাধিক ছবি আঁকা সাহিত্য রচনা এই বাড়িটিতে বসেই করেছেন তিনি।
অবন ঠাকুরের পিতা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকস্মিক মৃত্যুর পর নদীতীরবর্তী বাগান বাড়িটি চিরতরে পরিত্যক্ত হয়। তারপর বহু সময়ের অজ্ঞাত বাসের পর ২০০৭ সাল নাগাদ বাগানবাড়িটিকে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেন।
কোন্নগর বাগানবাড়ির উল্টোদিকে, অর্থাৎ গঙ্গার পূর্বতীরে পানিহাটিতেও ঠাকুর পরিবারের একটি বাগানবাড়ি আছে যা ‘পেনেটির বাগানবাড়ি’ নামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন রচনায় উল্লেখ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: কলকাতার ভিতরে সেরা ৩০ টি বেড়ানোর জায়গা
কিভাবে পৌছবেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ি
- সড়ক পথে: কলকাতা থেকে গাড়িতে গেলে বালি ব্রীজ বা বিবেকানন্দ সেতু পার হয়ে ডানদিকে গঙ্গার পশ্চিম পাড় বরাবর জিটি রোড ধরে কেবল ৫ কিলোমিটার। রাস্তার ডান দিকেই পড়বে। গেটের সামনেই বেসরকারীভাবে গাড়ি বা বাইক রাখার জায়গা রয়েছে।
- ট্রেনে: ট্রেনে আসলে হাওড়া থেকে মেইন লাইনে কোন্নগর স্টেশনে নেমে একটা অটো বা টোটো নিয়ে নিন, মিনিট সাতেকেই পৌছে দেবে।
- লঞ্চে: কোন্নগর ফেরিঘাট (পাণিহাটি-কোন্নগর) থেকে জিটি রোডে উঠেই বাঁদিকে কয়েক পা হাঁটা। তবে টোটো নিলে একেবারে বাগান বাড়ির গেটে নামিয়ে দেবে।
কাছাকাছি আর কি দেখতে পারেন:
বেড়ানোর জায়গা হিসাবে না বলে যদি ইতিহাস বা ঐতিহ্যপূর্ণ জায়গা দেখতে যদি ভাল লাগে তবে এই বাগানবাড়ী থেকে উত্তরে ও দক্ষিণে ঠিক একই ভাবে গঙ্গা ও জিটি রোডের মাঝখানে আরও বেশ কয়েকটি স্থান রয়েছে সেগুলি হল:
১. কোন্নগর ১২ মন্দির ঘাটের ঠিক পরেই: দিনেমারদের ১৭৫৫ সালে নবাব আলীবর্দীর অনুমতি নিয়ে একটি জাহাজঘাটা স্থাপন করেন। এখানে জাহাজ সারানোর পাশাপাশি মাল ওঠানো নামানোও হত। পরবর্তীকালে ১৮৪৫ সালে শ্রীরামপুর তথা এই গোটা অঞ্চলের শাসনভার ব্রিটিশদের হাতে গেলে এই জাহাজঘাটা ক্রমশ পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
২ . ঠিক এই জাহাজ ঘাটার সংলগ্ন দেশের প্রথম বাটার ফ্যাক্টরির তৈরি হয়েছিল, যার ভগ্নাবশেষ এখন রয়েছে।
৩ . অরবিন্দ ভবন ( বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের পৈত্রিক বাড়ি )
৪ . লাল কুঠি, হেয়ওয়ার্ডস এবং ওয়াল্ডির – আজকের বিখ্যাত মদ হেয়ওয়ার্ডসের পথচলা শুরু হয়েছিল ঠিক এখান থেকে গঙ্গাতীরের এই কোন্নগর থেকে। রয়েছে ডেভিড ওয়াল্ডির (David Waldies) নাম যিনি ক্লোরোফর্মকে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন মানবদেহের এনেস্থেটিক হিসেবে।
আমরা যারা সপ্তাহান্তে কাছেপিঠে বাড়াতে ভালবাসি বা হয়ত কিছুটা সময় একটা আশ্রমিক পরিবেশে কাটাতে চান তাহলে কয়েকঘন্টা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন হুগলী জেলার কোন্নগরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ির উদ্দেশ্যে।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবে জন্মগ্রহণ করেন?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭ ই আগস্ট ১৮৭১ সালে জন্মগ্রহণকরেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবে মারা যান?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৫ ই ডিসেম্বর ১৯৫১ সালে, ৮০ বছর বয়সে মারা যান।
তাঁর রচিত শিশুসাহিত্য কোনগুলি?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লিখিত শিশুসাহিত্য রাজকাহিনী, বুড়ো আংলা এবং ক্ষীরের পুতুল আজ আমাদের সাহিত্যের সম্পদ।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷