কোচবিহার জেলার দর্শনীয় স্থান হিসাবে সবার আগে কোচবিহার রাজবাড়ি কেই উল্লেখ করতে হয়। কোচবিহার ১৯৫০ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের জেলা হিসাবে গন্য হয়। তার আগে পর্যন্ত কোচবিহার শাসন করত কোচ রাজারা। তবে কোচবিহার শহরটি যে কোনও আধুনিক পরিকল্পিত শহরের মতো অবকাঠামোগত এই সুন্দর পরিকল্পিত শহর। সাথে সাথে জায়গাটি বেশ নিরিবিলি এবং শান্ত, শহুরে ব্যস্ততা বা কোলাহল মুক্ত এবং পারিপার্শিক অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানকার আবহাওয়া চারপাশে প্রকৃতির আপনার শরীর ও মনকে সতেজ করে।
কোচবিহার জেলার দর্শনীয় স্থান কোনগুলি?
কোচবিহার রাজবাড়ি
কোচবিহার রাজবাড়ি কোচবিহার শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এতদঞ্চলের মুখ্য আকর্ষনিয় স্থাপত্য, যা আবার ‘ভিক্টর জুবিলি প্যালেস’ নামে পরিচিত। কোচ রাজবংশের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের শাসনকালে ১৮৮৭ সালে নির্মিত হয়েছিল। এটি বর্তমানে একটি জাদুঘর। লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের আদলে তৈরি দোতলা রাজপ্রাসাদ আয়তনে প্রায় ৫১ হাজার বর্গফুটেরও বেশি। সামনে চওড়া রাজপথ ও দুই পাশে চমৎকার বাগান। প্রাসাদের সামনে রয়েছে দুটি কামান। প্রধান ফটকে রয়েছে কোচ রাজাদের রাজকীয় প্রতীক চিহ্ন।
প্রাসাদের প্রধান গম্বুজের ঠিক নিচেই রাজসভা কক্ষ যেখানে রেনেসাঁ শৈলীর ছাপ সর্বত্র। এই কোচবিহার রাজবাড়িটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে মিউজিয়াম হিসাবে রূপান্তরিত বা সংরক্ষিত, কারন আপনি ভিতরে প্রবেশ করলেই কোচ রাজবংশ ও তাদের সময়কাল সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারনা করতে পারবেন। রাজসভা কক্ষের আশেপাশেই রাজবংশের অনেকের মুর্তি, শিকারের সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র, শাহি সিলমোহর এমনকি সে যুগের আধুনিকতার নিদর্শন হিসাবে বিলিয়ার্ড বর্ড ইত্যাদি সাজান রয়েছে। হ্যাঁ, এই রাজবাড়ি বা মিউজিয়ামের প্রবেশ মূল্য ২৫টাকা।
মদনমোহন মন্দির
রাজবাড়ি থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত মদনমোহন মন্দির কোচবিহার জেলার অত্যন্ত জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। কোচবিহারের রাজাদের কুলদেবতা মদনমোহন। একসময় এই মন্দির ছিল রাজবাড়ির সীমানায়। ১৮৮৯ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ বৈরাগি দীঘির উত্তর পাড়ে এই মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করেন। কোচবিহারের অধিকাংশ মন্দিরের মত এটাও বাংলা চার চালার অনুকরণে চারকোণ ঘরের বাঁকানো কার্নিশের উপর গম্বুজ বসিয়ে বানানো। তবে পাশাপাশি চারটি ঘর থাকায় দালান মন্দিরের প্রভাব ও কিছু প্রতিফলিত। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ২০২০ সালে মন্দিরটিকে হেরিটেজ স্থাপত্য ঘোষণা করে।
মদনমোহনের ঘরের উপরেই প্রধান গম্বুজটি স্থাপিত। তার উপর পদ্ম, কলস, আমলক প্রভৃতি পর পর সাজান আছে। মন্দিরের সামনে সমতল ছাদের বারান্দা। মন্দিরটির বৈশিষ্ট হল এখানে ঠাকুর মদনমোহন রাধা বিহীন । মদন মোহন ঠাকুরের ঘরের পুর্ব দিকের ঘরে মাতারা এবং পশ্চিম দিকের ঘরে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত। মদনমোহন মন্দির হল কোচবিহারের মানুষের প্রাণের সম্পদ এবং প্রাণের ঠাকুর। কোচবিহারবাসীর যেকোনও পুণ্য পবিত্র কাজে প্রথম প্রণম্য স্থান এই মদনমোহন বাড়ি। এ প্রসঙ্গে এই উল্লেখনীয় ব্যাপার যে, মহারাজারা কোচবিহারের প্রতিটি মহকুমা শহরে একটি করে মদনমোহন ঠাকুরবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন।
বাণেশ্বর শিবমন্দির
বানেশ্বর শিব মন্দির হল কোচবিহারের জনপ্রিয় মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম। শিব মন্দিরটি প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে কোচবিহার-আলিপুরদুয়ার প্রধান সড়কের মধ্যবর্তী বাণেশ্বর গ্রামে অবস্থিত। বানেশ্বর শিব মন্দির প্রতিষ্ঠার কোন প্রামান্য সময় পাওয়া যায়না তবে স্থানীয় মানুষের ধারনা কোচ রাজবংশের মহারাজা নরা নারায়ণ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানে বানেশ্বর শিব মন্দির একটি রাজ্য সংরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে গিয়েছে।
বাণেশ্বর অর্থাৎ দেবাদিদেব মহাদেব এখানে পূজিত হন। মন্দিরের প্রধান দালান থেকে ১০ ফুট নিচে গর্ভগৃহে রয়েছে শিবলিঙ্গ। একেবারে কাছাকাছি রয়েছে একটি গৌরীপাট যেখানে বহু মানুষ পুজো দেন। এ ছাড়াও একটি মন্দিরে রয়েছে শিব ও অর্ধনারীশ্বর মূর্তি ও আরেকটি মন্দিরে মা কালীমূর্তি। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মন্দিরপ্রাঙ্গণ খোলা থাকে। শিবচতুর্দশীর সময় সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে এই মন্দির প্রাঙ্গনে। মূল মন্দিরের ঠিক পাশেই রয়েছে একটি বড় পুকুর। সেখানে বেশকিছু কচ্ছপ ভেসে বেড়ায়। সাধারণ দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে।
রসিকবিল
কোচবিহার রসিকবিল ভ্রমণে পর্যটকরা আসেন মূলত পরিযায়ী পাখিদের টানে ৷ হরেক প্রজাতির পাখির দেখা মেলে রসিকবিল ঝিলে। কোচবিহার জেলার অন্যতম মহকুমা শহর তুফানগঞ্জের অন্তর্গত রসিকবিলের অবস্থান কোচবিহার শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার এবং আলিপুরদুয়ার শহর থেকে মাত্র ৩৪ কিলোমিটার দূরে ৷ রসিকবিল প্রায় ১৭৫ হেক্টর জুড়ে এক বিশাল প্রাকৃতিক ঝিল এবং একে ঘিরে আশেপাশের প্রায় ৮০০ হেক্টর জুড়ে বনভূমি ৷ প্রকৃতপক্ষে রসিকবিল একটি নিচু জলাভূমি৷
পর্যটকদের কাছে রসিকবিলে নৌকাবিহার অত্যন্ত আকর্ষনিয় একটা বিষয়। আর ফটোগ্রাফি যদি আপনার পছন্দের হয় তবে অবশ্যই নৌকা নেবেন ৷ শীতের সময় এখানে পরিযায়ী পাখির প্রাচুর্য চোখে পড়ার মত। শুধু পরিযায়ী নয়, স্থানীয় প্রজাতি যেমন শামুকখোল, নানা ধরনের বক অর্থাৎ কোচবক, বাচকা, হট্রিটি, বালুবাটান, পানকৌড়ি, চখাচখি ইত্যাদি পাখিদের সংখ্যা চোখে পড়ার মত ৷ জলার সংলগ্ন জঙ্গলে আরও নানা রকমের পাখি যেমন বসন্তবৌরি, নীলকান্ত বসন্তবৌরি, খঞ্জন, দোয়েল, বুলবুল, নীলকণ্ঠ, মোহনচূড়া, সাইবেরিয়ান স্টোনচাট, মিনিভেট, নানারকমের মাছরাঙা, বাঁশপাতি, বাবুই, ফিঙে, বেনেবউ ইত্যাদি৷ এককথায় শীতকালে রসিকবিল হয়ে ওঠে পাখিদের স্বর্গরাজ্য ৷
রসিকবিলের লাগোয়া একটা ছোট চিড়িয়াখানা ‘রসিকবিল মিনি জু’ আছে, যেখানে হরিণ, ময়ূর, কুমির, চিতাবাঘ, কচ্ছপ, সাপ রয়েছে৷ এটি সকাল ৯টা থেকে পর্যটকদের উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়া হয় এবং এটি বন্ধ হয় বিকেল ৪টার সময়। বর্তমানে কোন টিকিট লাগে না।
তোর্সা নদী
কোচবিহার শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত তোর্সা বা তোরষা নদী। তোরষা অর্থ রুষ্ট জলপ্রবাহ। সত্যিই তোর্সা খরস্রোতা এক দুর্দান্ত নদী। বিভিন্ন ঋতুতে বদলে যায় তার রূপ। ভরা বর্ষায় দুকূল ছাপিয়ে যায় কিন্তু বসন্তে, গ্রীষ্মে, শীতে অনেকটাই শান্ত। জলের দিকে তাকিয়ে অনেকটা সময় কাটানো যায়। দূরে নৌকা আপন খেয়ালে ভেসে যায় । তোর্সার চরে কাছের ও দুরের বহু মানুষ এখানে পিকনিক করতে আসেন। নদীর তীরে আছে লোকদেবতা মাসান ঠাকুরের মূর্তি। মাসান ঠাকুরকে অনেকেই বলেন অপদেবতা। কখনও আবার শিবের অনুষঙ্গ হিসেবে পূজিত। স্থানীয়রা খুব ভক্তি করেন। তবে জেলার বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার ধারে মাসান ঠাকুরের মুর্তি চোখে পড়ে।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷