কলকাতার সেরা ১০ টি দেখার জায়গা বাছাই করা আর আঙ্গুরের গুচ্ছ থেকে সেরা দুটি বাছা সমান কঠিন। সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আধুনিকতায় সমৃদ্ধ এই শহরে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে।
কলকাতার সেরা ১০ টি দেখার জায়গা কোনগুলি জেনে নিন
কলকাতা – সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্যের শহর। ব্রিটিশ ভারতের প্রাক্তন রাজধানী এই শহর আজও তার ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে আধুনিকতার ছোঁয়ায়। বর্তমানে শহরের পরিবহনব্যবস্থা, সৌন্দর্যায়ন এবং পর্যটন সুযোগ-সুবিধার অনেক উন্নতি হয়েছে। তাই কলকাতা ঘুরে দেখার এটাই একেবারে আদর্শ সময়। চলুন দেখে নিই এমন ১০টি স্থান যেগুলো এবছরে কলকাতা ভ্রমণে মিস করা একদমই উচিত নয়।
১. ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল – কলকাতার আইকনিক দর্শনীয় স্থান
কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল রানী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। এটি কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে পরিচিত, যা ৫৭ একর জমির উপর বিস্তৃত। এখানে রয়েছে ২১টি সুসজ্জিত সবুজ উদ্যান, ২৮ হাজারেরও বেশি শিল্পকর্ম এবং ৩,৯০০টি চিত্রকলার সম্ভার। এই উজ্জ্বল স্মৃতিস্তম্ভটি শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসনের সাক্ষ্য বহন করে না, এটি উন্নত ও অসাধারণ স্থাপত্যকলার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবেও প্রতিভাত হয়।
📌 কি দেখবেন:
- মিউজিয়াম গ্যালারি
- সন্ধ্যার আলোকসজ্জা
- স্নিগ্ধ বাগান
📅 ভ্রমণের সেরা সময়: নভেম্বর–ফেব্রুয়ারি
পড়ে দেখুন: কিভাবে একদিনে কলকাতা ঘুরে দেখবেন, কি খাবেন সব খবর
২. ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম – ভারতের প্রাচীনতম জাদুঘর
কলকাতার নিকটবর্তী অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান হল ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম বা ভারতীয় জাদুঘর, যা বিশ্বের নবম প্রাচীনতম জাদুঘর এবং ভারতের সবচেয়ে বড় জাদুঘর হিসেবে বিবেচিত হয়। ‘জাদুঘর’ নামে পরিচিত এই স্থানে সংরক্ষিত রয়েছে বহুমূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন, যার মধ্যে রয়েছে সমকালীন চিত্রকলা, গৌতম বুদ্ধের পবিত্র স্মারক এবং মিশরের মমি। এর পাশাপাশি এখানে রয়েছে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর অলঙ্কার, জীবাশ্ম, কঙ্কাল, প্রাচীন সামগ্রী, অস্ত্রশস্ত্র এবং অত্যাশ্চর্য মুঘল চিত্রকলা।
🆕 নতুন আকর্ষণ :
- নতুন ফসিল গ্যালারি
- আধুনিক ইন্টারঅ্যাকটিভ ডিসপ্লে
🕒 সময়: সকাল ১০টা – বিকেল ৫টা (সোমবার বন্ধ)
৩. হাওড়া ব্রিজ – কলকাতার বিখ্যাত সেতু
‘সিটি অব জয়’ কলকাতার অন্যতম প্রতীকী স্থাপনা হাওড়া ব্রিজ, যা ১,৫০০ ফুট লম্বা এবং ৭১ ফুট চওড়া। গঙ্গার অন্যতম শাখা নদী হুগলি নদীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই সেতুটি কলকাতার অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি রাবীন্দ্র সেতু নামেও পরিচিত এবং এর উপর দিয়ে প্রতিদিন ১০০,০০০-এরও বেশি যানবাহন এবং অসংখ্য পথচারী চলাচল করেন। এর বিশেষত্ব হল, এটি তৈরি করা হয়েছে একটিও নাট বা বল্ট ব্যবহার না করে—সম্পূর্ণ রিভেটের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বে এই ধরনের দীর্ঘতম ক্যান্টিলিভার ব্রিজগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
📸 টিপস:
- মল্লিক ঘাট (ফুলের হাট) থেকে ছবি তুলুন
- সন্ধ্যার আলোয় ব্রিজের সৌন্দর্য দেখুন
পড়ে দেখুন: কলকাতার 10 টি বিখ্যাত মন্দির জেনে নিন সব খবর
৪. দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির – পুণ্যার্থীদের তীর্থস্থান
কলকাতা এমন একটি গন্তব্য, যেখানে লুকিয়ে রয়েছে কয়েকটি অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। এর মধ্যে অন্যতম হল দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির, যা শুধুমাত্র তার গঠনশৈলীর জন্যই নয়, বরং শ্রীরামকৃষ্ণ দেব ও স্বামী বিবেকানন্দের আধুনিক ভারতবর্ষে তার প্রভাব জন্যও বিখ্যাত। হুগলি নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত এই মন্দির দেবী ভবতারিণীর প্রতি উৎসর্গীকৃত, যিনি দেবী কালী-এর এক রূপ। এই ঐতিহাসিক নবরত্ন শৈলী, স্থাপত্যকলায় সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।
🚶 পরামর্শ:
- সকাল বেলায় যান ভিড় কম থাকে
- গঙ্গার ঘাটে বসে সময় কাটান (দক্ষিণেশ্বর)
৫. ইকো পার্ক – কলকাতার আধুনিক প্রাকৃতিক থিম পার্ক
ইকো পার্ক একটি পরিবেশবান্ধব পার্ক যা এক অনন্য ও মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা প্রদান করে। প্রায় ১০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই পার্কটি প্রকৃতি প্রেমী ও বাইরের পরিবেশ উপভোগ করতে ইচ্ছুকদের জন্য আদর্শ গন্তব্য।
এই পার্কে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, ঝোপ, ঘাস, বুনো ফুলসহ বহুপ্রজাতির পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও সরীসৃপ দেখা যায়। এছাড়া পার্কের লেক, পুকুর ও জলধারা পর্যটকদের শান্ত পরিবেশে নৌকাভ্রমণের সুযোগ প্রদান করে। পার্কের বিশেষ আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে ট্রি-টপ ওয়াকওয়ে, অ্যাডভেঞ্চার জোন, খেলনা ট্রেন ও প্রজাপতি উদ্যান। দর্শনার্থীরা এখানে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, বন্যপ্রাণী দেখা, এবং পাখি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এছাড়াও, এখানে বোটিং, কায়াকিং, মাছ ধরা এবং রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার যেমন জিপ লাইন, রোপ কোর্স ও বাঞ্জি জাম্পিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে।
🆕 আকর্ষণ :
- জ্যাপানিজ ফরেস্ট
- ক্যাম্পিং জোন
- মিনি ৭ আশ্চর্য
- ৭টি আশ্চর্যের প্রতিকৃতি
- কায়াকিং, সাইক্লিং
- রাতের ফোয়ারা শো
🎟 খুবই জনপ্রিয়: পরিবার ও প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে
আরও পড়ুন: কলকাতার বিনোদন ও থিম পার্ক – কোথায়, কখন খোলে
৬. সায়েন্স সিটি – শিশু ও বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য শ্রেষ্ঠ স্থান
পূর্ব মেট্রোপলিটান বাইপাসের পার্ক সার্কাস সংযোগস্থলে অবস্থিত সায়েন্স সিটি কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ। শিক্ষা এবং বিনোদনের এক অপূর্ব মিশ্রণ এই স্থানে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে। এটি ১ জুলাই ১৯৯৭ সালে উদ্বোধন করা হয়েছিল। সায়েন্স সিটি একাধারে শিক্ষা ও মজার মেলবন্ধন ঘটায়। এখানে রয়েছে অ্যাকোয়ারিয়ামে কিছু বিরল ও মনোরম জলজ প্রাণী। এই জটিল স্থাপনায় রয়েছে স্পেস ওডিসি, ডাইনামোশন, সায়েন্স এক্সপ্লোরেশন হল, মেরিটাইম সেন্টার, আর্থ এক্সপ্লোরেশন হল এবং সুবিস্তৃত সায়েন্স সিটি পার্ক—যা দর্শকদের জন্য আজীবন মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
✨ নতুন সংযোজন:
- মেটাভার্স এক্সপেরিয়েন্স
- রোবোটিক শো
৭. পার্ক স্ট্রিট – ফুডি ও নাইটলাইফ প্রেমীদের স্বর্গ
পার্ক স্ট্রিট কলকাতার একটি প্রাণবন্ত এলাকা যা ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। এটি খাদ্যপ্রেমীদের জন্য এক আদর্শ স্থান যেখানে রাস্তার খাবার থেকে শুরু করে অভিজাত রেস্তোরাঁ পর্যন্ত সব ধরনের স্বাদ গ্রহণ করা যায়।
🍴 খাবারের হটস্পট
- লুচি, চাট ও বিখ্যাত কলকাতা রোলসহ রঙিন রাস্তার খাবারের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ।
- ফ্লুরিস, মকাম্বো এবং পিটার ক্যাটের মতো ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁ ভ্রমণ।
- ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের খাবার উপভোগ করার জন্য আধুনিক রেস্তোরাঁ ও ক্যাফের সমাহার।
খাবারের বাইরের আকর্ষণ:
- সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ: ভারতীয় জাদুঘর ও অক্সফোর্ড বুকস্টোর পরিদর্শন।
- ঐতিহাসিক গুরুত্ব: ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্য ও চিহ্নগুলো দেখা।
- নাইটলাইফ: বার, পাব ও ডিসকো ক্লাবের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
🎶 নাইটলাইফ: Live মিউজিক ও ক্লাব কালচার
৮. কুমোরটুলি – কলকাতার পটুয়া পাড়া
উত্তর কলকাতার সরু গলিতে অবস্থিত কুমারটুলি হল শহরের বিখ্যাত মৃৎশিল্পীদের বসতি। এখানকার শিল্পীরা বছরের পর বছর ধরে দুর্গা পূজার জন্য মাটির প্রতিমা তৈরি করে থাকেন। এই স্থানটি পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক মাটি, বাঁশ, খড়, কাদামাটি ও মাটির সাহায্যে সেরা প্রতিমা গড়ার জন্য সুপরিচিত।
📷 ভ্রমণের সেরা সময়: জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর
🎨 এক্সপেরিয়েন্স:
- ওয়ার্কশপ ট্যুর
- ফটোগ্রাফি
- কুমারদের ওয়ার্কশপ
- প্রতিমা তৈরির লাইভ ডেমো
৯. প্রিন্সেপ ঘাট – গঙ্গার তীরের সৌন্দর্য
কলকাতার অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান প্রিন্সেপ ঘাট। এটি গ্রীক ও গথিক স্থাপত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা হয়েছে এবং হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত। কলকাতার অন্যতম সেরা রাতের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য এটি উপযুক্ত স্থান।
🚣 করার মত কাজ
- বোটিং
- চা-কফির সঙ্গে আড্ডা
- নতুন “লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো” (২০২৫ এ যুক্ত)
১০. আলিপুর চিড়িয়াখানা – পরিবার নিয়ে ঘোরার জন্য উপযুক্ত
আলিপুর চিড়িয়াখানা ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এটি ভারতের প্রাচীনতম চিড়িয়াখানাগুলোর মধ্যে একটি। এটি ৪৬ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত এবং বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। এখানে রয়েছে সিংহ, জিরাফ, বিরল পাখি ও সরীসৃপসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। এই আলিপুর চিড়িয়াখানার সবুজ পরিবেশ, শান্ত জলাধার এবং চমকপ্রদ প্রদর্শনী দর্শকদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
🦓 জানার মতো:
- রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার
- পেঙ্গুইন এনক্লোজার
- ইকো-ফ্রেন্ডলি রাইডস
অতিরিক্ত: আরও কিছু দর্শনীয় স্থান
📍 অফবিট গন্তব্য:
- মার্বেল প্যালেস
- কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া
- সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থান
🔚 উপসংহার: কলকাতায় ঘুরে দেখার জায়গাগুলোর সারাংশ
২০২৫ সালে কলকাতায় ঘুরে দেখার স্থান খুঁজছেন? এই তালিকাটি আপনার জন্য একেবারে উপযুক্ত। ঐতিহ্য, আধুনিকতা, খাবার, উৎসব – সবকিছু একসঙ্গে খুঁজে পেতে চাইলে কলকাতাই আপনার পরবর্তী ভ্রমণ গন্তব্য হওয়া উচিত।
🗨️ আপনার প্রিয় স্থান কোনটি? কমেন্টে জানান!
🔁 পোস্টটি শেয়ার করুন আপনার ভ্রমণপ্রেমী বন্ধুদের সাথে!

প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷