মুর্শিদাবাদ জেলাতে রয়েছে ৫১ সতীপীঠের অন্যতম কিরীটেশ্বরী মন্দির। মুর্শিদাবাদ শহরের অপর পাড়ে অর্থাৎ ভাগীরথীর পশ্চিম পারে জঙ্গলাকীর্ণ নানা মন্দির অধ্যুষিত কিরীটেশ্বরী গ্রাম। বেশ কিছু প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ মনে করিয়ে দেয় পূর্ব গৌরবের স্মৃতিকথা। হিন্দু ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞে সতীর কিরীট অর্থাৎ মুকুট পতিত হয়েছিল এই কিরীটকণা গ্রামে। তাই এই গ্রাম শাক্ত সাধনার অন্যতম স্থল আর প্রতিষ্ঠিত দেবী কিরীটেশ্বরী হিসেবে সমাদৃতা। এভাবে মুর্শিদাবাদের এই জায়গাটিও বর্তমানে কিরীটেশ্বরী গ্রাম নামেই বেশি পরিচিত।
কিরীটেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস (History of Kiriteswari temple)
কিরীটেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে অনেক মত প্রচলিত আছে। যেমন, এই গ্রামের পূর্বের নাম ছিল কিরীটকণা কারন এখানে সতীর মুকুটের কণা পড়েছিল। লিখিত ইতিহাস অনুসারে ১১০৪ বঙ্গাব্দে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন নাটোরের রানি ভবানী। পরবর্তী সময়ে মহারাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ রাই ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে এই মন্দিরের সংস্কার করেন। আবার কিরীটেশ্বরীর প্রাচীন মন্দিরটি ১৪০৫ সালে ভেঙে পড়ে গেলে ওই পুরনো মন্দিরের সামনেই ১৯ শতকে লালগোলার রাজা দর্পনারায়ণ রায় নতুন মন্দিরটি তৈরি করেন।
প্রাচীন ও নতুন অর্থাৎ দুটি মন্দিরই রয়েছে ঐস্থানে। প্রাচীন বা আদি মন্দিরে ছোট বেদির ওপর দেবীর মুখ আঁকা আছে। মন্দিরে দেবীর কোনও মূর্তি নেই। এমনকী, কোনও ছবিও এখানে পূজিত হয় না। শিলামূর্তিকেই দেবী-রূপে পুজো করা হয়। এই শিলাটির রঙ লাল এবং শিলাটি একটি আবরণে ঢাকা থাকে। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর অষ্টমীতে এই আবরণটি পরিবর্তন করা হয়। দুটি মন্দিরেই পূজা নিবেদিত হয়। কিরীটেশ্বরী গ্রামটিতে আরও অন্যান্য মন্দির রয়েছে। গ্রামের উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে এক দালান-মন্দির, যা গুপ্তমঠ নামে পরিচিত। কথিত আছে, এখানে নাকি দেবীর কিরীট রাখা আছে। মন্দিরটি রানি ভবানী কর্তৃক নির্মিত।
কিরীটেশ্বরী গ্রামে ধর্ম সমন্বয় (Religious unity at Kiriteswari)
মা কিরীটেশ্বরী এখানে দক্ষিণাকালী ধ্যানে পূজিতা। বাংলার এই মা কালী সকলের। তার কাছে ধর্মের কোনও ভেদাভেদ নেই। তার কাছে সব সন্তান সমান। শাক্তমতে এই স্থান একটি প্রাচীন মহাপীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ। পাঠান-মুঘল শাসনকালেও এই স্থানের সুখ্যাতি ছিল । দেবী মন্দির যে জাগ্রত সেই নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত। কথিত আছে, পলাশীর যুদ্ধের পর যখন বাঙলার ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র মীরজাফর, নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁর সঙ্গী রাজা রাজবল্লভকে নির্মম ভাবে হত্যা করেন। সেই দিন এই মন্দিরের একটি শিবলিঙ্গ নাকি নিজে থেকেই ফেটে গিয়েছিল।
শোনা যায়, মিরজাফর তার অন্তিম শয্যায় শয়ান তখন তার ইচ্ছানুসারে এই মন্দির থেকে আনা চরণামৃত মুখে দেওয়ার পরই মৃত্যু হয়। এইসব কাহিনির সত্য-মিথ্যা নিরূপণ এখানে সম্ভব নয়। তবে এ-থেকে এটুকু বোঝাই যায়, দেবী কিরীটেশ্বরীকে বাংলার হিন্দু মুসলমান তাদের নিজেদের অংশ বলেই ভেবেছে। বর্তমানে মন্দিরের দায়িত্ব রয়েছে যে কমিটির উপর তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য মুসলিম। আসলে হিন্দু শক্তিপীঠ হলেও ধর্ম সমন্বয়ের অন্যতম দৃষ্টান্ত এই কিরীটেশ্বরী। ভাগীরথীর পূর্ব পারের নহবত আর সানাইয়ের সুরের সঙ্গে পশ্চিমপারের ঘণ্টা-কাঁসরের শব্দ মিশে সম্প্রীতির এক অনন্য ঐক্যতান সৃষ্টি করেছে।
কিরীটেশ্বরী মন্দিরে কীভাবে যাবেন (How to reach Kiriteswari village)
কলকাতা থেকে আসলে বাস বা ট্রেনে সোজা চলে আসুন বহরমপুর বা হাজারদুয়ারি। সেখান থেকে থেকে প্রথমে ভাগীরথী নদীর তীরে ফেরি ঘাটে আসতে হবে। সেখান থেকে নদী পার করে টোটো ভাড়া করে ঘণ্টা খানেকের আগেই পৌঁছে যাবেন কিরীটেশ্বরী মন্দির। পুরো টোটো রিজার্ভ মোটামুটি ৭৫০ থেকে ১০০০ টাকা। মানে চার জনের ভাড়া ওই একই পড়বে।
কোথায় থাকবেন কিরীটেশ্বরী গ্রামে (Where to stay at Kiriteswari)
কিরীটেশ্বরী মন্দিরের কাছে থাকার তেমন ব্যবস্থা নেই। বহরমপুর বা হাজারদুয়ারি থেকে হোটেল নিয়ে থাকলে সেখান থেকে এখানে সহজেই আসা যায়৷ বহরমপুর বা হাজারদুয়ারি কাছে প্রচুর হটেল রয়েছে যেখানে ভাড়া মোটামুটি ৫০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে ৷ তবে বর্তমান মন্দির কমিটির সদস্যদের আন্তরিকতায় এটা স্পষ্ট যে খুব শীঘ্রই এই গ্রামেই পর্যটনের প্রাথমিক সুবিধাগুলি, যেমন থাকার জন্য হোমস্টে বা খাবার জন্য হোটেল ইত্যাদির অভাব রয়েছে তা দ্রুততার সঙ্গে পুরন করার চেষ্টা করছেন।
কিরীটেশ্বরীর কাছাকাছি দেখার জায়গা
কিরীটেশ্বরী মন্দির ছাড়াও এখানে এলে কাছেপিঠের মধ্যেই ঘুরে আসতে পারেন বাংলার নবাবদের খোসবাগ, রোশনিবাগ ৷ এছাড়াও, ডাহাপাড়া ধাম ঘুরে আসতে পারেন৷ যদি হাজারদুয়ারি থাকেন তবে একটা দিন মুর্শিদাবাদ শহরটা দেখে নিতে ভুলবেন না।
কিরীটেশ্বরী গ্রাম বেড়াতে কেমন খরচ
সবথেকে সাশ্রয় হয় যদি চারজন একসাথে থাকেন। সেক্ষেত্রে পুরো ভ্রমণ অর্থাৎ কিরীটেশ্বরী মন্দিরে ঘোরা, এক রাত থাকা-খাওয়া, ট্রেন এবং টোটোর ভাড়া, নদী পারাপার এসব মিলিয়ে হাজার পাঁচেকে হয়ে যাবে। অর্থাৎ মাথাপিছু ১৩০০ টাকা মত।
আরও পড়ুন – হাজারদুয়ারি সহ ১২টি ঐতিহাসিক ভ্রমণ গন্তব্য
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷