নদীয়া জেলায় অনেকগুলি দুদার্ন্ত দর্শনীয় স্থান রয়েছে যেগুলি প্রতি বছর বহু সংখ্যক দেশী ও বিদেশী পর্যটক আকর্ষন করে। কারন হিসাবে বলা যেতে পারে যে – নদীয়া পশ্চিমবঙ্গের খুব পুরান জেলাগুলির মধ্যে একটি। প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষাকেন্দ্র। নদীয়া জেলা একটি প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষাকেন্দ্র এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গুরুত্বপুর্ন অংশ। সম্ভবত পলাশী যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ঐতিহাসিক অঞ্চল হিসেবে নদিয়া জেলার আত্মপ্রকাশ হয়। নদীয়ায় শ্রীচৈতন্যদেব এবং তাঁর ভক্তি আন্দোলনের প্রভাবে সমগ্র দেশেরই এই অঞ্চল সম্পর্কে গভীর আগ্রহ আছে। নদীয়া জেলার সদর কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলের জগৎজোড়া নাম এবং শান্তিপুরের তাঁতের শাড়ির সুবর্ন ইতিহাসে আগ্রহ সবার। তবে আমরা এখানে সেরা ৭টি জায়গা সম্পর্কে জানব।
নদীয়া জেলার সেরা দর্শনিয় স্থানগুলি কি কি?
১ – মায়াপুর
মায়াপুর নদিয়া জেলার দর্শনিয় স্থানগুলির মধ্যে প্রথম শ্রেণীতেই পড়ে। মায়াপুর নবদ্বীপের কাছে যেখানে গঙ্গা ও জলঙ্গী নদী মিশেছে সেখানে একটি বিশেষ গ্রাম। মায়াপুর মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মস্থান হিসাবে সমগ্র বৈষ্ণব ধর্মানুরাগিদের কাছে অত্যন্ত পবিত্রভুমি হিসাবে মান্য। মায়াপুর আবার ইস্কনের সদর দপ্তরও বটে। মায়াপুর ইস্কন নির্মিত বেশ কিছু মন্দির আছে, যেমন চন্দ্রোদয় মন্দির, প্রভুপাদের সমাধি বা শ্রী চৈতন্য মঠ ইত্যাদি। ভক্ত এবং পর্যটকদের প্রধান আকর্ষন হল এখানকার ভব্য চন্দ্রোদয় মন্দির।
কিভাবে যাবেন মায়াপুর
সড়কপথে কলকাতা থেকে নদীয়া জেলার মায়াপুর যাওয়া যায়। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে কৃষ্ণনগর এসে তারপর কৃষ্ণনগর থেকে বাসে মায়াপুর যাওয়া যায়।
মায়াপুরে থাকবার জায়গা
বাস থেকে নেমেই মায়াপুর প্রবেশ করতে বিভিন্ন হোটেল বা লজে থাকার সুব্যবস্থা আছে।
২ – নবদ্বীপ
নবদ্বীপ, নদীয়া জেলা সদর শহর, কৃষ্ণনগর থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত। বলাযেতে পারে নবদ্বীপ নদীয়ার পর্যটন গন্তব্যের মধ্যমণি। এই নবদ্বীপ অতীতে বাংলার সেন বংশের শাসক রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী ছিল। এই নবদ্বীপই ভগবান শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও লীলাভুমি। নদীয়া জেলার এই পুন্যভুমিতেই জন্ম হয় বৈষ্ণব ধারনা এবং ভক্তিবাদের। দূর দুরান্ত থেকে বৈষ্ণব পন্ডিতগনের আগমন হত এই নবদ্বীপে। স্বাভাবিক ভাবের অনেক মন্দিরও প্রতিষ্ঠা হয় নবদ্বীপ ও সন্নিকট অঞ্চলে বিগত কয়েক শতক ধরে। সরকারি হিসাবে এখানে প্রায় ১৮৬ টি মন্দির রয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য হলঃ- শ্রী শ্রী কেশবজি মঠ, জল মন্দির, পোড়ামা তলা মন্দির, বুড়ো শিব মন্দির ইত্যাদি। নবদ্বীপের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম হল রাস-উৎসব
কিভাবে যাবেন নবদ্বীপ
ট্রেনে – হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে নবদ্বীপ যাওয়া যায়। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে প্রথমে কৃষ্ণনগরে পৌঁছতে হবে, তারপর ন্যারোগেজ লাইনে ট্রেন ধরে নবদ্বীপ ধামে পৌঁছে ফেরি পেরিয়ে নবদ্বীপে যাওয়া যায়। অথবা বাসে করে সরাসরি নবদ্বীপে পৌঁছনো যায়। এছাড়া কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে অটো করে স্বরূপগঞ্জ ঘাটে পৌঁছে ফেরিঘাট পেরিয়ে নবদ্বীপ যাওয়া যায়।
নবদ্বীপে থাকার জায়গা
নবদ্বীপধাম স্টেশনের কাছে মিউনিসিপ্যালিটির ট্যুরিস্ট লজ, এছাড়াও বেসরকারি লজ, ধর্মশালা ও অথিতিশালায় পর্যটকদের থাকার সুবন্দোবস্ত আছে।
৩ – কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি
নদিয়ার জেলা সদর হল কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগরের নামকরণ করা হয়েছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের নাম থেকেই। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এর রাজত্বকালে নির্মিত তাঁর রাজবাড়ীটি বর্তমানে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দেখার মত একাধিক বস্তু থাকলেও রাজবাড়ির বিরাট পুজো মণ্ডপ যেখানে দুর্গাপুজো আর জগদ্ধাত্রী পুজো নদীয়া জেলার অন্যতম দর্শনীয়। পুজো মণ্ডপের গায়ে পঙ্খের বিচিত্র কারুকার্য অতুলনীয়। পুজো মণ্ডপের থাম, খিলান ইত্যাদিতেও রাজকীয় ছাপ লক্ষ্য করা যায়। এই ধরনের বিশাল পুজো মণ্ডপ পশ্চিমবঙ্গে খুব বেশি নেই। কৃষ্ণচন্দ্র রায় মহা সমারোহে এই পারিবারিক দুর্গাপুজো করতেন। শোনাযায় তিনিই প্রথম সর্বসাধারণের মধ্যে দুর্গোৎসবের প্রচলন করেন যা পরবর্তী কালে সর্বজনীন পুজোর পরিচিতি পায়।
কিভাবে যাবেন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি যেতে হলে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সকালের লালগোলা প্যাসেঞ্জার বা কৃষ্ণনগর লোকালে উঠুন। নেমে পড়ুন কৃষ্ণনগর স্টেশনে। স্টেশন থেকে ব্যাটারিচালিত ই রিকশায় পৌঁছে যান রাজবাড়ি। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরেও যেতে পারেন। তবে রাজবাড়ির পূজা মন্ডপ দেখতে হলে বারোদোল বা অন্য কোন উৎসবের আসতে হবে আপনাকে।
৪ – বল্লাল ঢিপি
বামুনপুকুর বাজারে অর্থাৎ ভক্ত চাঁদ কাজীর সমাধিস্থল থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই দেখাযায় সুবিখ্যাত বল্লাল ঢিপি। দ্বাদশ শতকের শেষদিকে বাংলার সেন রাজাদের দ্বিতীয় শাসক বল্লাল সেনের নাম অনুসারে এই ঢিপির নামকরন করা। বল্লাল ঢিপি নদীয়া জেলার একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন গন্তব্য। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে একটি বড় ইমারতের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়, যেটি বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ বলে মনে করা হয়। প্রত্নতত্ব বিভাগের প্রচেষ্টায় আরও অনেক পোড়ামাটির ভাস্কর্য, তামার পাত্র ও অন্যান্য নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রতি বছরই অনেক পর্যটক আসেন এটি দেখতে।
বল্লাল সেন রচিত “অদ্ভুতসাগর” উল্লেখ অনুসারে অনুমান করা হয় যে, এই বল্লাল ঢিপির প্রাচিনত্ব আটশো বছরের বেশি। আবার অনেকে প্রপিতামহ সামন্ত সেনের প্রাসাদের ধংসস্তুপ বলে মনে করেন। ইতিহাসবিদ পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে বল্লাল ঢিপির নিচে চাপা পড়ে আছে বিজয় সেনের প্রাসাদ। তবে যাই হোক না কেন, নদীয়া জেলার এই ধংসস্তুপটি বল্লাল ঢিপি নামেই খ্যাত।
৫ – শিবনিবাস
শিবনিবাস হল নদীয়া জেলার মাজদিয়ার কাছে একটি সুন্দর জনপদ, চুর্নি নদী এখানে গোল হয়ে যেন এই জায়গাটিকে সুরক্ষা প্রদান করছে। এই জায়গাটির একটি ইতিহাস হল, এক সময় এখানে নসরত খাঁ নামে এক দুধর্ষ ডাকাত ছিল। আর তাঁর নামে এই জায়গাটার নাম ছিল নসরত খাঁর বেড়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র যখন এই মাজদিয়ার জঙ্গলে আসেন এবং ডাকাত দমনের পর এই জায়গাটি তাঁর খুব পছন্দ হয়। সেই সময় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বর্গী আক্রমন থেকে সুরক্ষার জন্য নদীয়ার রাজধানী সময়িক ভাবে স্থানান্তরিত এখানে করেন এবং এই স্থানের নতুন নামকরন করেন “শিবনিবাস”।
তিনি এখানে ১০৮টি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের মধ্যে দুটি শিব মন্দির ও রাম-সীতা মন্দির আজ অবশিষ্ঠ আছে এবং বাকী মন্দির কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে । প্রথম মন্দিরটি অত্যন্ত্য জনপ্রিয় “রাজরাজেশ্বর” মন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরের বিশাল কষ্টি পাথরে নির্মিত শিবলিঙ্গ, নদীয়া জেলার তথা পুর্বভারতের বৃহত্তম হিসাবে সমাদৃত।
কিভাবে যাবেন শিবনিবাস
- ট্রেনে – দুভাবে আসা যায় এই শিবনিবাসে, প্রথম প্রকার – শিয়ালদহ থেকে গেদে লোকালে উঠে মাজদিয়া নেমে পড়ুন । মাজদিয়া স্টেশন থেকে হাঁটা পথে শিবনিবাস। দ্বিতীয় প্রকার – শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল বা লালগোলা প্যাসেঞ্জারে উঠে কৃষ্ণনগর নামুন তারপর কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে বাসস্ট্যান্ডে আসুন, বাস বা টোটো (ভাড়া ১০টাকা) সেখান থেকে বাসে উঠুন মাজদিয়া আসুন (ভাড়া ২০ টাকার মত)
- নিজস্ব গাড়িতে – কোলকাতা থেকে সোজা কৃষ্ণনগর -> মাজদিয়া আসেন তাহলে শিবনিবাস মোড়ে চুর্নি নদীর উপর একটি সেতু পার হতে হবে। এখানে অবশ্যই গাড়ি থামিয়ে একটু চারিদিক দেখবেন, ভীষণ ভাল লাগবে।
৬ – বেথুয়াডহরী
কাছাকাছি কোথাও একবেলা ঘুরে আসার চিন্তা যদি আপনার মনে থেকে থাকে তবে বেথুয়াডহরি বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য আদর্শ জায়গা। নদিয়া জেলার মধ্যেই বেশ নিরিবিলি আর নির্ঝঞ্ঝাট এই অভয়ারন্য। প্রকৃতির মাঝে সুন্দর গাছ গাছালির মাঝে নানা রকমের প্রানীদের মাঝে এক নিরিবিলি অবসর যাপন করে আসুন। ‘বেথুয়া’ হল একটি শাকের নামে, আর ‘ডহরী’ অর্থাৎ জলাশয়। সত্যই এই জায়গাটা এই ধরনের শাকে পরিপুর্ন জলাভুমি ছিল আর তা থেকেই এই জায়গাটির এরকম নাম হয়েছে।
এই অভয়ারন্যে প্রায় ১৬৭ হেক্টর জায়গা জুড়ে চিতল হরিণ, ময়ুর, মুনিয়া বা আরও অনেক প্রজাতির পাখি ছাড়াও অজগর, কচ্ছপ, ঘড়িয়াল, সারস সবাই একসাথে আছে এবং তাঁদের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বেড়ে ছলেছে।
সবশেষে বলাযায় আপনার আপনজনদের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়ে সুন্দর স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
কীভাবে যাবেন বেথুয়াডহরী
- ট্রেনে – শিয়ালদ থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ধরুন আর সোজা বেথুয়াডহরি পৌঁছতে দুই ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগে। সেখান থেকে টোটো, রিক্সা কিংবা গাড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায় অভয়ারণ্যে।
- বাসে – এস্প্লানেড থেকে প্রচুর প্রাইভেট বাস সার্ভিস আছে (বহরমপুর, মালদা, দার্জিলিং ইত্যাদি) যেকোন একটি ধরে সোজা বেথুয়াডহরী ।
- গাড়িতে – যদি প্রাইভেট গাড়িতে যান তবে এন এইচ ৩৪ ধরে কৃষ্ণ নগর হয়ে পৌঁছে যান। যাত্রাপথের দৈর্ঘ্য তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি হওয়া উচিত নয়।
বেথুয়াডহরীতে কোথায় থাকবেন
এখানে স্টেট ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কটেজ আছে ‘বেদুইন’ যাত্রিনিবাস। আগে থেকে পরিকল্পনা করে বুক করে যাওয়াই শ্রেয়।
৭ – সোনার গৌরাঙ্গ
সোনার গৌরাঙ্গ নবদ্বীপের শতাধিক মন্দিরের মধ্যেও অন্যতম। মন্দিরটি বাংলার বৈষ্ণব ভাবধারার স্রষ্টা মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য দেবের সোনার মূর্তির জন্য বিশেষ ভাবে পরিচিত। ভগবান শ্রীচৈতন্য দেবের খড়ম বা পাদুকা এই মন্দিরে সংরক্ষিত আছে। অপুর্ব, দৃষ্টি নন্দন এই মন্দিরটি নির্মান করান প্রতাপ চন্দ্র গোস্বামী নামে মহাপ্রভুর একজন ভক্ত। প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত ও দর্শনার্থীরা এই মন্দির ও সোনার গৌরাঙ্গ মুর্তি দর্শন করতে আসেন।
কলকাতার কাছেই হাওড়া জেলার দারুন ৭টি দর্শনিয় স্থানের খবর পেতে ক্লিক করুন এখানে।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷