কলকাতার সেরা মিষ্টির দোকান: বিখ্যাত ১২ টি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের তালিকা

বিখ্যাত ১২ টি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান পেয়েছে কলকাতার সেরা মিষ্টির দোকান, যেগুলি একাধারে বাংলার মিষ্টির ঐতিহ্য ও অন্যদিকে আধুনিক ফিউশন মিষ্টিও তৈরি করে থাকেন।

কলকাতার সেরা মিষ্টির দোকান: বিখ্যাত ১২ টি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের তালিকা

মিষ্টি আর বাঙালির মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সুসম্পর্ক সেই প্রাচীন কাল থেকে রয়েছে । খাওয়ার শেষ পাতে অথবা কোন শুভ অনুষ্ঠানে মিষ্টি ছাড়া বাঙালির কিছুতেই চলে না। তাই কলকাতা সহ বাংলার যে কোনও জায়গায় গেলেই আর কিছু না থাক মিষ্টির দোকান অবশ্যই চোখে পড়বে। কলকাতার মিষ্টি মানেই সকলের প্রথম পছন্দ রসগোল্লা। এমনই ১২ টি মিষ্টির দোকানের তালিকা রইল যাদের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক বহু দিনের।

১২ টি বিখ্যাত ও কলকাতার সেরা মিষ্টির দোকান

রসগোল্লার স্রষ্টা ‘নবীন চন্দ্র দাস’ বা সুপ্রাচীন ‘গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দী’ ও কে সি দাস অর্থাৎ যারা ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির জন্য বিখ্যাতরা যেমন এই তালিকাতে আছে তেমনি রয়েছে যারা আধুনিক ফিউশন মিষ্টি তৈরিতে সুপ্রসিদ্ধ যেমন ‘বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক’, ‘নবকৃষ্ণ গুঁই’ এবং গাঙ্গুরাম ইত্যাদি। আসলে কলকাতায় ভাল মিষ্টির দোকানের তালিকা ১০০ র কম হলে টা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সুতরাং বলে যায় যে এই তালিকাতে অনেকের নামই অনিচ্ছাকৃত বাদ রয়ে গেল।

1. ভীম চন্দ্র নাগ (Bhim Chandra Nag)

ভীম চন্দ্র নাগ

ঠিকানা: ৫, নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট, বউ বাজার মার্কেটের কাছেই

১৮২৬ সালে পরাণ চন্দ্র নাগ প্রতিষ্টা করেন এই মিষ্টির দোকানটি। ভীম চন্দ্র নাগের হাত ধরে এই মিষ্টি দোকানটি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছয়। প্রসিদ্ধির কারণ ভীমচন্দ্র নাগের মনোহরা ও সন্দেশ। তবে ব্রিটিশ আমলে ভারতের গভর্নর জেনারেল চার্লস ক্যানিংয়ের স্ত্রী লেডি ক্যানিংয়ের নামে একটি যুগান্তকারী মিষ্টি তৈরি করে ফেলেন ভীম চন্দ্র নাগ, নাম ‘লেডি কেনি’। কখন ও কোন প্রেক্ষিতে লেডি ক্যানিংয়ের নামে এই মিষ্টির নামকরণ হল তা নিয়ে ইতিহাসে অনেক গল্প আছে। ছানা ও ময়দা দিয়ে তৈরি এবং চিনির তরল রসে ভেজানো লালচে-বাদামী রঙের গোলাকার ‘লেডিকেনি’র আবির্ভাব ঘটে ভীম চন্দ্র নাগের হাত ধরে।

বৌবাজার মার্কেটের ঢিল ছোড়া দূরত্বে ভীম চন্দ্র নাগের আইসক্রিম সন্দেশ, রোজ ক্রিম সন্দেশ , পেস্তা সন্দেশও ব্যাপক জনপ্রিয়। তা ছাড়া ভীম নাগের স্পেশাল ‘আবার খাবো সন্দেশ’ ও আমদই চেখে দেখতেই হবে।

2. কে সি দাস (K.C.Das)

কে সি দাস

ঠিকানা : ১১ এ, এসপ্লেনেড ইস্ট, কলকাতা

মিষ্টির দুনিয়ায় বিপ্লব এসেছে এই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই। বিশেষত, নানা স্বাদের রসগোল্লা তৈরিতে এদের জুড়িমেলা ভার। যে কারণে ১৮৬৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কে সি দাসের সুনাম একটুও কমেনি। এখনে এলে প্রথমেই চোখে পড়ে নানা স্বাদের রসগোল্লা। আর ট্রাই করতে পারেন ক্ষীর কদম বা সন্দেশ। কে সি দাসের রসমলাইও কিন্তু বেশ জনপ্রিয়।এসপ্লানেট মেট্রোর পাশে এই মিষ্টির দোকানে শীতকালে নলেনগুড়ের সন্দেশ, রসগোল্লা আপনি যদি চেখে না দেখেন, তাহলে বলব কলকাতার মিষ্টির স্বাদ নেওয়া আপনার অপূর্ণ রয়ে গেল৷ পাশাপাশি কে সি দাসের নলেরগুড়ের রোল, ল্যাংচা আপনি খেয়ে দেখতে পারেন৷

আরও পড়ুন: কলকাতার সেরা আইসক্রিম পার্লারগুলি

3. বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক (Balaram Mullick & Radharaman Mullick)

বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক

ঠিকানা : ২, পদ্মপুকুর রোড, ভবানীপুর, কলকাতা
এছাডা়ও কসবা, নিউ আলিপুর, প্রিন্স আনওয়ার শাহ রোড, পার্ক স্ট্রিট এবং বালিগঞ্জেও এদের শাখা রয়েছে।

১৮৮৫ সাল বলরাম মল্লিক এবং রাধারমণ মল্লিকের পথ চলা শুরু। কলকাতার প্রাচীনতম মিষ্টির দোকান গুলির মধ্যে একটি হল বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক। চিরাচিরত বাঙালি মিষ্টি তো বটেই, সেই সঙ্গে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা ফিউশন মিষ্টিও বিক্রি হয় এখানে, যার মধ্যে চকোলেট মিষ্টির জনপ্রিয়তা সবথেকে বেশি। বিখ্যাত এই মিষ্টির দোকানের গন্ধরাজ সন্দেশ, রাবড়ি প্রসিদ্ধ৷ এছাড়া এই দোকানের ছানার পায়েস, রসগোল্লাও আপনি একবার খেয়ে দেখতে পারেন৷ এখানকার জলভরা সন্দেশ ও আম সন্দেশ না খেলেই নয়।

4. সেন মহাশয় (Sen Mahasay)

সেন মহাশয়

ঠিকানা : ১/১সি শিবদাস ভাদুড়ি স্ট্রিট, শ্যামবাজার, কলকাতা
এছাড়াও লেক মার্কেট, গড়িয়াহাট, সল্টলেক এবং ভবানীপুরেও এদের শাখা রয়েছে।

সীতাভোগ আর মিহিদানার যুগলবন্দির জন্য বিখ্যাত বর্ধমান। তবে কলকাতাতেও এই মিষ্টির সেরা ঠিকানা সেন মহাশয় I মনোহরা, দরবেশ এবং নানা স্বাদের সন্দেশ যেমন সুস্বাদু, তেমনই মালাই চপও কম মুখরোচক নয়। এই কারণেই কলকাতার সেরা মিষ্টির দোকানগুলির লিস্টে একেবারে উপরের দিকে সেন মহাশয়কে না রাখলেই নয়।

আরও পড়ুন: কলকাতার নাইটলাইফ গন্তব্য কোনগুলি?

5. গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দী (Girish Ch. Dey & Nakur Ch. Nandy)

গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দী

ঠিকানা : ৫৬, রামদুলাল সরকার স্ট্রিট, হেদুয়া, হাতিবাগান, কলকাতা

আজ থেকে প্রায় ১৭৫ বছর আগে, ১৮৪৪ সালে পথ চলা শুরু। এত বছর পেরিয়ে গেছে, তবুও এদের মিষ্টির মান একই রয়ে গেছে। তাই তো গিরিশ চন্দ্র আর নকুড় চন্দের জনপ্রিয়তা এত বছরেও একটুও কমেনি। কলকাতার অন্যতম পুরানো মিষ্টির দোকান৷ হেদুয়া পার্কের কাছে অবস্থিত এই মিষ্টির দোকানটি সব সময়ই আলাদা করে নজর কাড়ে ৷

এখানকার মিষ্টির জনপ্রিয়তার মূল কারণ হল মান ও স্বাদ ধরে রাখা। এখানকার নলেন গুড়ের সন্দেশ, সৌরভ সন্দেশ, চকোলেট সন্দেশের মধ্যে চকো তুফান, চকোলেট মালাই রোলের গুণমুগ্ধের সংখ্যা বিশাল। তা ছাড়া এখানকার ছানার সন্দেশ এবং জলভরা সন্দেশও অবশ্যই চেখে দেখার মতো।

6. নবকৃষ্ণ গুঁই (Nabakrishna Guin)

নবকৃষ্ণ গুঁই

ঠিকানা : ৯ বি, নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট, বউবাজার, কলকাতা।

কলকাতা শহরের ইতিহাসের সঙ্গে যে-যে মিষ্টির দোকানের নাম জড়িয়ে, তাদের মধ্যে অন্যতম হল এই দোকান। এরা নানা স্বাদের ট্র্যাডিশনাল বাঙালি মিষ্টি যেমন বিক্রি করে, তেমনই ফিউশন মিষ্টিরও হদিশ মিলবে এখানে। বিশেষত, এদের রোজ ক্রিম সন্দেশ এবং চন্দন ক্ষীরের মতো মিষ্টির স্বাদ তো না ভোলার মতো।এদের রোজ ক্রিম সন্দেশ এবং চন্দন ক্ষীর ট্রাই করতে পারেন।

আরও পড়ুন: কলকাতার সেরা 10 টি ক্যাফে বা কফি শপ

7. নবীন চন্দ্র দাস (Nobin Chandra Das)

নবীন চন্দ্র দাস

ঠিকানা : ৭৭ যতীন্দ্র মোহন এভিনিউ, শোভাবাজার

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে জানা যায় সেই ১৯ শতকে প্রথম রসগোল্লার অবিষ্কার হয়। বাগবাজারের এক ছোট্ট মিষ্টির দোকানের মালিক নবীন চন্দ্র দাস প্রথমবার তৈরি করেছিলেন বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় এই মিষ্টিটি। পরবর্তী সময় অন্যান্য মিষ্টি বিক্রেতাদের হাত ধরে রসগোল্লা জগৎ বিখ্যাত হয়ে ওঠে নবীন চন্দ্র দাস।

8. নলীন চন্দ্র দাস অ্যান্ড সন্স (Nalin Chandra Das & Sons)

নলীন চন্দ্র দাস অ্যান্ড সন্স

ঠিকানা : ৩১৩, রবীন্দ্র সরণি, নতুন বাজার, কলকাতা।
এছাড়াও এদের রাসবিহারি, হেদুয়া, নিউ টাউন এবং ইকো পার্কের বাংলা মিষ্টি হাবেও শাখা রয়েছে।

এই প্রতিষ্ঠান ১৯৩ বছরের ঐতিহ‌্য বহন করে চলেছে। নানা স্বাদের সন্দেশ খেতে যদি মন চায়, তা হলে একবার পৌঁছে যেতেই পারেন এই মিষ্টির দোকানে। বিশেষত, এদের বাটার স্কচ জলভরা সন্দেশের জনপ্রিয়তা তো আকাশ ছোঁয়া।

9. গাঙ্গুরাম (Ganguram)

গাঙ্গুরাম

ঠিকানা: ৩৮ বি, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট, বহুবাজার
এছাড়াও মানিকতলা, লালবাজার, পার্ক স্ট্রিট, দমদম, গোলপার্ক ইত্যাদি কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় শাখা রয়েছে।

গাঙ্গুরামের মিষ্টি, ছানার পাকে যেন জাদুকাঠির ছোঁয়ানো। প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো এই মিষ্টির দোকান আজও জয়ধ্বজা উড়িয়ে চলেছে। গাঙ্গুরামের মিষ্টি, আজও কলকাতার নানা প্রান্তে মেলে। ইন্দ্রাণী, রসমালাই, ক্ষীরের চপ, প্রাণহরা, প্যারাডাইস, দিলখুশ, ক্ষীর চমচম, আবার খাব, লাইট ডিলাইটের পাশাপাশি আলফান্সো আর কেশর আমের মিশ্রণে তৈরি আম দই, আম সন্দেশ গাঙ্গুরামের বিখ্যাত মিষ্টির তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে।

এই আম দই বা আম সন্দেশে কোনও রকমের এসেন্স ব্যবহার করা হয় না। নিখাঁদ আমের নির্যাস। সে আমও আসে মহারাষ্ট্র থেকে।মিষ্টি ছাড়াও রাধাবল্লভি, আলুরদম, শিঙাড়া, দই বড়া, পনির রোল, ভেজিটেবল চপ, চাউমিন, মটর প্যাটিসও পাওয়া যায় গাঙ্গুরামে।

10. বাঞ্ছারাম (Banchharam)

বাঞ্ছারাম

ঠিকানা : বি/৪, বাঘা যতীন মার্কেট কমপ্লেক্স, যাদবপুর, কলকাতা
এছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে এদের বহু শাখা রয়েছে।

১৯৭৬ সালে মধ্য কলকাতায় একটা ছোট্ট দোকান থেকে শুরু। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় এই মিষ্টির দোকানের মালিক বাঞ্ছারাম ঘোষকে। আজ কলকাতার প্রথম সারির মিষ্টির দোকানগুলির মধ্যে অন্যতম হল এটি।

এই দোকানের মিষ্টি স্বাদের জন্য অল্প সময়েই বিপুল পরিমাণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এদের রসগোল্লা এবং সন্দেশ যেমন জনপ্রিয়, তেমনি পুলি পিঠে এবং মিহিদানার জনপ্রিয়তাও কম নয়। বিশেষত, বাঞ্ছারামের ভ্যানিলা এবং স্ট্রবেরি সন্দেশ একবার চেখে না দেখলেই নয়। মিষ্টি দই খেতেই হবে। সঙ্গে রসগোল্লা এবং রাধাবল্লভিও চেখে দেখতে পারেন।

11. শ্রী হরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার (Sri Hari Mmistanna Bhandar)

1 sri hari

ঠিকানা : ৩৪ বি, শোভাবাজার স্ট্রিট, লাল মন্দিরের কাছে

১৯০৭ সালে হীরালাল ঘোষের হাত ধরে চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পথ চলা শুরু হয়। ৩৪ বি, শোভাবাজার স্ট্রিটের চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লার চাহিদা এখনও একইরকম ঊর্ধমুখী। তাছাড়াও এখানকার চকোলেট সন্দেশ, মালাই চমচম, গুলাব জামুন, মিষ্টি দইর নাম রয়েছে। কারও কারও মত, এই মুহূর্তে কলকাতার সেরা রসগোল্লা যেসব দোকানে পাওয়া যায় তার মধ্যে প্রথমে চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।

12. চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার (Chittaranjan Mistanna Bhandar)

1 chittaranjan

ঠিকানা : ৩৪ বি, শোভাবাজার স্ট্রিট, লাল মন্দিরের কাছে

১৯০৭ সালে হীরালাল ঘোষের হাত ধরে চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পথ চলা শুরু হয়। ৩৪ বি, শোভাবাজার স্ট্রিটের চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লার চাহিদা এখনও একইরকম ঊর্ধমুখী। তাছাড়াও এখানকার চকোলেট সন্দেশ, মালাই চমচম, গুলাব জামুন, মিষ্টি দইর নাম রয়েছে। কারও কারও মত, এই মুহূর্তে কলকাতার সেরা রসগোল্লা যেসব দোকানে পাওয়া যায় তার মধ্যে প্রথমে চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।

13. দ্বারিক গ্র্যান্ড সন্স (Dwariks Grandsons)

1 dwarik grandsons

ঠিকানা : ১২৫/২, বিধান সরণি, শ্যামবাজার, কলকাতা।

বাহারি জাঁকজমক নেই কিন্তু নানা স্বাদের মিষ্টির অফুরন্ত ভান্ডার এখানে। অতুলনীয় এদের তৈরি মিষ্টির স্বাদ। তাই কলকাতার সেরা মিষ্টির দোকানগুলির লিস্টে দ্বারিককে না রাখলেই নয়। কোনওদিন শ্যামবাজার চত্ত্বরে এলে একবার ঢুঁ মারতেই পারেন কলকাতার অন্যতম পুরানো এই মিষ্টির দোকান

Leave a Comment