পশ্চিমবঙ্গের বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ভ্রমণ বা ইকো-ট্যুরিজম কয়েক বছর ধরে বেশ কিছু বন্যপ্রাণী প্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইকো-ট্যুরিজম আপনাকে সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা ভাবনা বা প্রকৃতি-ও-পরিবেশের সামঞ্জস্য বুঝতে সহায়তা করে। বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সম্পর্কে আরও ভাল করে জানার সুযোগ করে দেয় যা ভারতীয় ইকোট্যুরিজমের মুখ্য উদ্দেশ্য। আসুন এরাজ্যের সেরা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যগুলি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক, যাতে আপনার পরবর্তী ট্রিপের জন্য প্যাক আপ করা সহজ হয়।
পশ্চিমবঙ্গে সেরা ইকো-ট্যুরিজম গন্তব্য: সেরা 6 টি
1. চাপড়ামারী: পশ্চিমবঙ্গের বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
চাপরামারী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য জলপাইগুড়ি জেলার পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত। এটি দার্জিলিং শহর থেকে প্রায় 100 কিলোমিটার দূরে গোরুমরা জাতীয় উদ্যানের কাছাকাছি অবস্থিত। এটিকে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সেরা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বলা যেতে পারে। চাপড়ামারী নামটি ‘চাপরা’ থেকে এসেছে যার অর্থ বিভিন্ন ধরণের ছোট মাছ এবং ‘মারি’ অর্থ প্রচুর। প্রায় 100 বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে চাপড়ামারী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইতিহাস অনুযায়ী ১৮৯৫ সালে, ভারতীয় বন আইনের অধীনে এলাকাটিকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ভারত সরকার ১৯৯৮ সালে এটিকে জাতীয় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা করে।
অভয়ারণ্যের প্রধান আকর্ষণ হল হাতি যা এখানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। স্থানটি গৌর, বন্য শূকর, চিতাবাঘ, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, হিমালয়ান ল্যাঙ্গুর, হরিণ, সরীসৃপ ইত্যাদির মতো অন্যান্য প্রাণীর আবাসস্থল। এছাড়াও পাখি পর্যবেক্ষকদের স্বর্গ হিসাবে বিবেচিত হয় কারণ আপনি ময়ূর, সবুজ পায়রা, রোলারের মতো বিভিন্ন পাখি দেখতে পারেন।
- ভ্রমণের সময়কাল: পুরো দিন
- অবস্থান: মূর্তি টাউনের কাছে।
- পরিবহন বিকল্প: ক্যাব
- ভ্রমণ টিপস: বর্ষাকালে (১৬ জুন – ১৫ সেপ্টেম্বর) অভয়ারণ্য বন্ধ থাকে।
- সময়: সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা
- থাকার জায়গা: এখানে বন বিভাগের কটেজগুলির পাশাপাশি প্রাইভেট হোটেলগুলি পাওয়া যায় যা খাবার এবং থাকার ব্যবস্থা করে।
2. সজনেখালী: সেরা ইকো-ট্যুরিজম গন্তব্য
সজনেখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য সুন্দরবন রিজার্ভের অন্তর্বর্তী ৩৬২ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে রয়েছে। ম্যানগ্রোভ অরণ্য এখানকার প্রধান আকর্ষণ। তা ছাড়া দর্শনার্থীরা পাখি, বন্যপ্রাণী, উভচর এবং মাছের বিশাল বৈচিত্র্য দেখতে এখানে আসেন। প্রধান বন্যপ্রাণী আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে রিসাস ম্যাকাকস, স্পটেড ডিয়ার, ওয়াইল্ড বোয়ার, ফিশিং বিড়াল, কুমির এবং ওটার। এছাড়াও শ্লথ ভালুক, প্যান্থার, চিঙ্কারা বা বন্য হগও আপনার চোখে পড়তে পারে।
- ভ্রমণের সময়কাল: 2 ঘন্টা
- অবস্থান: সজনেখালী, দক্ষিণ 24 পরগণা
- দেখার সর্বোত্তম সময়: সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাস
- কীভাবে পৌঁছাবেন: কেউ সরাসরি সোনাখালীতে ড্রাইভ করতে পারেন এবং সেখান থেকে সজনেখালীতে ফেরি যাত্রা করতে পারেন।
- থাকার বিকল্প: সুন্দরবন গেটওয়ে রিসোর্ট
পড়তে পারেন: সুন্দরবন জঙ্গল ক্যাম্প ম্যানগ্রোভ অরণ্য সহ
3. রমনাবাগান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
রমনাবাগান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি রমনাবাগান মিনি চিড়িয়াখানা নামেও পরিচিত যা প্রায় ১৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে বর্ধমানের কেন্দ্রস্থলে মৌজা বাবুরবাগে অবস্থিত। আমরা যদি সংক্ষিপ্তভাবে উক্ত অভয়ারণ্যের বিবর্তন সম্পর্কে কথা বলি তবে আমরা এটিকে একটি সংরক্ষিত বন থেকে একটি হরিণ পার্কে রূপান্তর দিয়ে শুরু করতে পারি ১৯৭৮ সালে কেবল ছয়টি স্পটেড (দাগযুক্ত) হরিণ দিয়ে শুরু করেছিল এবং পরে এটিকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
লম্বা এবং সুন্দর সেগুন, সাল এবং অন্যান্য পরিচিত গাছগুলির মধ্যে, এই অভয়ারণ্যটি বিভিন্ন দিকথেকে একটি সেরা অভয়ারণ্য হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। এটি বেশ কয়েকটি বন্যপ্রাণী প্রজাতির আবাস বলে পরিচিত যা এখানে তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল যেমন ধূসর ল্যাঙ্গুর, কালো হরিণ, সাপ, পেঁচা, সারস, মঙ্গুস, চিতাবাঘ এবং আরও বেশ কয়েকটিতে বসবাস করতে দেখা যায়।
- ভ্রমণের সময়কাল: 2 থেকে 3 ঘন্টা
- অবস্থান: গোলাপবাগ, বাবুরবাগ, বর্ধমান জেলা
- ভ্রমণের সেরা সময়: বর্ষাকাল
- কীভাবে পৌঁছাবেন: বর্ধমান রেলওয়ে স্টেশন 4 কিমি দূরত্বে এবং একটি ট্যাক্সি বা লোকাল বাস ভাড়া করতে পারেন।
- থাকার বিকল্প: কাছাকাছি বেশকিছু হোটেল বা লজ আছে।
4. কুলিক পাখি অভয়ারণ্য
রায়গঞ্জ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বর্তমানে কুলিক পাখি অভয়ারণ্য নামে পরিচিত যেটি পশ্চিমবঙ্গে পাখি পর্যবেক্ষকদের স্বর্গ বলা হয়। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির এই আশ্রয়স্থলটি উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের কাছে অবস্থিত। অভয়ারণ্যটিতে প্রায় ১৬৪ রকমের প্রজাতির পাখিদের আশ্রয় দেয় এবং প্রতি বছর প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার পরিযায়ী পাখি এই অভয়ারণ্যে এসে বাস বাঁধে এবং বংশ বিস্তার করে। অভয়ারণ্যটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম পাখি অভয়ারণ্য বলে গণ্য হয়। কুলিক পাখি-অভয়ারণ্য ইংরেজদের “U” আকৃতির কৃত্রিম খালের একটি জটিল নেটওয়ার্কের সাথে কুলিক নদীর সাথে সংযুক্ত। রায়গঞ্জ পাখি অভয়ারণ্য যার আয়তন ৩৫ একর এবং বাফার এলাকা ২৮৬ একর, একটি দারুন নানা প্রজাতির পাখিদের জন্য আদর্শ বাসস্থান।
আবাসিক পাখিদের মধ্যে রয়েছে ফ্লাইক্যাচার, চিল, পেঁচা, কাঠঠোকরা, মাছরাঙ্গা, ড্রোঙ্গো এবং আরও অনেক ধরনের পাখি। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকা এবং দক্ষিণ এশীয় এলাকা থেকেও প্রতি বছর এখানে প্রচুর পরিযায়ী পাখি উড়ে আসে। এদের মধ্যে প্রধান পরিযায়ী প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ইগ্রেট, ওপেন-বিল স্টর্ক, কালো-মুকুট নাইট হেরন, পন্ড হেরন, ইন্ডিয়ান শ্যাগ, লিটল কর্মোরেন্টস এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে এশিয়ান ওপেনবিল। পাখি ছাড়াও, অভয়ারণ্যের উদ্ভিদ এবং বন্যপ্রাণীর বহিরাগত সংগ্রহ এছাড়াও আকর্ষণীয়।
- ভ্রমণের সময়কাল: সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত
- অবস্থান: রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর
- ভ্রমণের সেরা সময়: শীতকাল (তবে সারা বছরই অসা যায় )
- কীভাবে পৌঁছাবেন: রায়গঞ্জ স্টেশন থেকে ৩ কিমি দূরত্বে অবস্থিত এবং একটি ট্যাক্সি বা টোটো ভাড়া করতে পারেন।
- থাকার বিকল্প: কাছাকাছি হোটেল বা লজ ছাড়াও পর্যটন উন্নয়ন পরিষদের ‘দিনান্তে’ একদম গেটেক উল্টোদিকেই রয়েছে।
5. সেঞ্চাল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
এটি দার্জিলিং-এ অবস্থিত একটি বেশ পুরানো বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। সেঞ্চাল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য প্রায় ৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। অভয়ারণ্যে বিভিন্ন যে বিভিন্ন ধরণের পাখি ও প্রাণী দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে রিসাস মাঙ্কি, হিমালয়ান ফ্লাইং স্কুইরেল, আসাম ম্যাকাক, ওয়াইল্ড বোয়ার, বার্কিং ডিয়ার এবং আরও অনেক কিছু। এছাড়াও জঙ্গলে মধ্যে বনবিড়াল, চিতাবাঘ এবং হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ারের মতো কিছু বিপন্ন প্রজাতিও খুঁজে পেতে পারেন। এতে অনেক প্রজাতির পাখিও রয়েছে।
- ভ্রমণের সময়কাল: 2 ঘন্টা
- অবস্থান: সিটং খাসমহল
- দেখার সেরা সময়: সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ
- কীভাবে পৌঁছাবেন: অভয়ারণ্যটি দার্জিলিং শহর থেকে প্রায় 11 কিলোমিটার দূরে। দার্জিলিং থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করা যায়।
- থাকার বিকল্প: হামরো হোম, মিস্টিক রোধি রিসোর্ট
6. জোড় পোখরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
জোড় পোখরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি, পাহাড়ের রাণী, দার্জিলিংএ অবস্থিত। এটি হিমালয়ান সালামান্ডারের মতো উচ্চ-উচ্চতার প্রাণীদের আবাসস্থল যা স্থানীয়ভাবে গোরা নামে বিখ্যাত। এই জায়গাটি দার্জিলিং শহর থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে এবং বলা হয় যে এটি একটি পাহাড়ের চূড়ায় ভালভাবে অবস্থান করে এবং এর মনোরম দৃশ্যের জন্য অবশ্যই এটি একটি দর্শনীয়। এখানে দুটি পাশাপাশি অর্থাৎ যমজ হ্রদ রয়েছে এবং সেটাই কারণ এই নাম হওয়ার । নেপালি ভাষায় জোরে অর্থাৎ দুটি এবং পোখরির অর্থ হ্রদ। পশ্চিমবঙ্গের বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য সমূহের মধ্যে সবচেয়ে ছোট আয়তনের অভয়ারণ্য।
- ভ্রমণের সময়কাল: 3 থেকে 4 ঘন্টা
- অবস্থান: ডালকাঝার ফরেস্ট, পশ্চিমবঙ্গ
- ভ্রমণের সর্বোত্তম সময়: জুন থেকে আগস্ট মাস
- কীভাবে পৌঁছাবেন: দার্জিলিং থেকে 21 কিমি দূরে এবং একটি ট্যাক্সি ভাড়া করার পরামর্শ দেওয়া হবে।
- থাকার বিকল্প: জোড়পোখরি ট্যুরিস্ট লজ
জঙ্গলে কোন প্রকার সাফারি করার আগে কিছু পরামর্শ:
- বুকিং আগে থেকে করে রাখুন:
সাধারনত জীবজন্তুদের কাছে প্রজননের আদর্শ সময় হল বর্ষাকাল তাই সব জঙ্গল, অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যান বন্ধ থাকে। তাই বর্ষার পর খোলা মাত্রই পর্যটকদের ঢল নামে। তাই আগে থেকে বুকিং করে রাখতে হবে।
- পরিচয়পত্র সবসময় কাছে রাখুন:
সমস্ত অভয়ারণ্য, জঙ্গলগুলিতে চোরাশিকারীদের উপদ্রব অনেক, তাই সারা দিনে কত জন আনাগোনা করলেন, তার হিসাব রাখে সরকার। তাই গন্তব্য যে অভয়ারণ্যই হোক প্রত্যেকের সঙ্গে পরিচয়পত্র থাকা চাই। নিরাপত্তার কারণেই এই নিয়ম রয়েছে বহু দিন ধরেই। - গাড়ি থেকে নীচে নামবেন না:
খোলা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো বন্যপ্রাণ দেখার কৌতূহল এবং উত্তেজনা দু’টিই থাকে। তাই বলে অতিরিক্ত উৎসাহ দেখিয়ে যেখানে গাড়ি থেকে নামার কথা নয়, সেখানে নেমে পড়ার ভুল করবেন না। জঙ্গলের পথে পদে পদে বিপদ লুকিয়ে থাকে। তাই আপনার এবং অন্য সকলের জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবেন না।
- অনুজ্জ্বল পোশাক পরাই ভাল:
জঙ্গলে গেলে খুব কায়দার পোশাক না পরাই ভাল। গা ঢাকা কালো বা গাছ-গাছালির মতো রঙের ‘ক্যামোফ্লাজ়’ পোশাক পরে জঙ্গলে যান। এটাই দস্তুর। বন্যপ্রাণীদের চোখে ধুলো দেওয়াই এর মূল উদ্দেশ্য। কারণ, খুব কাছে থাকা কোনও প্রাণী যদি মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে যায়, তা হলে তাকে আর নাগালের মধ্যে পাওয়া যাবে না।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷