পূর্ব মেদিনীপুর পর্যটন দৃষ্টিকোন থেকে পশ্চিমবঙ্গের একটি ভীষণ জনপ্রিয় জেলা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দর্শনীয় স্থান যেমন পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্র সৈকতগুলি অর্থাৎ দীঘা, মন্দারমণি, তাজপুর, উদয়পুর, জুনপুট, বাঁকিপুট, শঙ্করপুর, বগুরান জলপাই এই জেলাতেই রয়েছে। তেমনি ঐতিহাসিক বা ধর্মিয় স্থান যেমন ৫০০ বছরের বেশি পুরান ৫১ সতীপীঠের অন্যতম বর্গভীমা মন্দির, তমলুকের প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর বা মহিষাদলের রাজবাড়ী এই জেলার উল্লেখযোগ্য পর্যটন গন্তব্যগুলির অন্যতম।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দর্শনীয় স্থান – সেরা ৭টি কোনগুলি?
1. দীঘা
দীঘা হল কলকাতার কাছাকাছি পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত ও পর্যটন কেন্দ্র। এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা প্রতি বছর দীঘা যান শুধুমাত্র সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকবেন বলে। সমুদ্র দেখতে চাইলে ওল্ড দীঘা এবং নিউ দীঘা দুয়েরই সৈকত অসাধারণ। এখানকার সমস্ত জায়গায় পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায়। সারাদিন সমুদ্র সৈকতে খেলাধুলো করে সময় কাটাতে পারেন।
চাইলে সমুদ্র তীরে কেবল চুপচাপ বসে সমুদ্রের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারেন। সমুদ্র সৈকতেই পাওয়া যায় সাওয়ারির জন্য ঘোড়া, নিউ দিঘায় রয়েছে অমরাবতী পার্ক। অমরাবতী থেকে দশ মিনিট দূরে রয়েছে দিঘা অ্যাকোরিয়াম। যেখানে সামুদ্রিক মাছ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। বেশ সুন্দর একটি দর্শনীয় স্থান কোনও প্রবেশ মূল্য নেই। এর ১৫ মিনিট দূরত্বে রয়েছে দীঘার নতুন আকর্ষন ঢেউ সাগর। সমুদ্রের পাড় ধরে হেঁটেই নিউ দীঘা পৌঁছোনো যায়। মিনিট দশেক হাঁটতে হবে। স্নান করার জন্য নিউ দীঘা সুবিধাজনক।
দীঘা ভ্রমণ সম্পর্কে বিশদ জানতে ক্লিক করুন
2. তমলুক রাজবাড়ী
তমলুক রাজবাড়ী হলদিয়ার একেবারে উপকণ্ঠে অবস্থিত। তমলুক রাজবাড়ীর বর্তমান ধ্বংসাবশেষ দেখেই স্থাপত্যের উজ্জ্বলতা কেমন ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষের ইট ও খিলানে ইউরোপীয় স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তমলুক রাজবাটী কমপ্লেক্সের ভিতরে একটি প্রশস্ত প্রাঙ্গণ রয়েছে। বাম এবং ডানদিকের অংশগুলি দ্বিতল ব্যারাকের মতো গঠনের এবং বামদিকের অংশগুলি ধ্বংসস্তূপে। আবার সামনের দিকে বিশাল মূল কাঠামো যা চওড়া স্তম্ভ বিশিষ্ট খোলা তাতে ইসলামিক স্থাপত্যের অনুরূপ খিলানে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয়রাও বিশ্বাস করেন যে এই প্রাসাদটি পৌরাণিক মহাকাব্য মহাভারতের সাথে জড়িত। কাশীরামদাসের মহাভারত অনুসারে, ভগবান শ্রী কৃষ্ণ এবং অর্জুন এখানে এসেছিলেন অশ্বমেধ যজ্ঞের ধার্মিক ঘোড়াটিকে ময়ূরা-ধ্বজা (ময়ূর) রাজবংশের রাজা ত্রম্রধ্বজ থেকে মুক্ত করতে। মহাভারত, ভাগবতেও এর উল্লেখ আছে। রাজবাটীর ধ্বংসাবশেষের জরাজীর্ণ অবস্থা, পর্যটকদের কাছে এটিকে আরও আকর্ষক ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
3. কপালকুন্ডলা মন্দির
কপালকুন্ডলা মন্দিরটি পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির দরিয়াপুরে অবস্থিত। কপালকুণ্ডলা – বঙ্কিম চন্দ্রের কালজয়ী উপন্যাসটি রসুলপুর নদীর সাথে দরিয়াপুর এবং দৌলতপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির উপর ভিত্তি করে। উপন্যাস অনুসারে, কপালকুণ্ডলাকে একজন কাপালিক (তান্ত্রিক) খুঁজে পান এবং লালিত হয়, যিনি মন্দিরে তার সাধনা করতেন। পরে নবকুমার এখানে কপালকুণ্ডলাকে খুঁজে পান।
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দরিয়াপুর ও দৌলতপুরে থাকার সময় বঙ্কিমচন্দ্র এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে অভিভুত হন। এ সময় তিনি এক তান্ত্রিকের সঙ্গেও দেখা করেন। শেক্সপিয়রের টেম্পেস্ট থেকে অনুপ্রাণিত কপালকুণ্ডলা উপন্যাসটি এই অঞ্চলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল।
এখানে প্রধানত দুটি মন্দির রয়েছে, একটি দালান শৈলীর চণ্ডী মন্দির এবং আটচালা শৈলীর শিব মন্দির। মনে করা হয় যে মন্দিরগুলি গ্রামবাসী আত্মরাম পাল তৈরি করেছিলেন। চণ্ডী মন্দিরটি একটি ইট নির্মিত পূর্বমুখী মন্দির যেখানে পোড়ামাটির অলঙ্করণ নেই। গর্ভগৃহের সামনে ৩টি খিলান বিশিষ্ট একটি বারান্দা রয়েছে।
4. ময়নাগড়
ময়নাগড় পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক মহকুমার ময়নায় অবস্থিত। তমলুক-শ্রীরামপুর রাস্তা দিয়ে গেলে তমলুক থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার। ময়নাগড়ের একটি অত্যন্ত ঐতিহ্যপুর্ন ইতিহাস রয়েছে। এখানে বৈষ্ণব-শৈব-শাক্তদের বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দির, বৌদ্ধ উপাসনালয়, মুসলিম সাধক মানিকপীরের মাজহার-শরীফ, মহন্তের সমাধি রয়েছে যেখানে বিভিন্ন ধর্মের হাজার হাজার ভক্ত তাদের প্রার্থনা করেন।
অতীতে ময়নাগড় একটি বৌদ্ধ মঠ ছিল এবং লাউসেন (লৌসেনা) ছিলেন একজন বৌদ্ধ রাজা। লৌসেনার ধর্মঠাকুর বুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন এবং এখান থেকেই ধর্ম ঠাকুরের উপাসনার সাধনা গড়ে ওঠে। ময়নাগড়ের রাজা মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবারে অত্যন্ত ধনী ও প্রিয় ছিলেন। ময়নাগড়ের রাজা প্রায় ৩০০০ সৈন্যবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ করতেন।
ময়নাগড় দুর্গের অনন্য কাঠামো একে অতুলনীয় করে তোলে। গড় বা দুর্গটি কালিদহ ও মকরদহ নামে দুটি পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। একসময় এই পরিখা গুলিতে প্রচুর কুমির বাস করত। পঞ্চরত্ন শৈলীর একটি পূর্বমুখী ইট-নির্মিত ও অপরটি পূর্বমুখী আটচালা কৃষ্ণমন্দির রয়েছে।
5. বর্গভীমা মন্দির
বর্গভীমা মন্দির বা ভীমকালী মন্দিরটি, প্রাচীন ও ঐতিহাসিক তাম্রলিপ্ত শহরের বিশাল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহনকারি তমলুকের নিকটেই অবস্থিত। এই কালী মন্দিরটি এই ঐতিহাসিক স্থানটির মূল আকর্ষণ রূপনারায়ণ নদীর তীরে মেচেদা-হলদিয়া রোডের কাছে অবস্থিতঅবস্থিত।
দেবী বর্গভীমার মন্দিরটি ১১৫০ বছর পুরানো (ময়ূরা-ধ্বজা (ময়ূর) রাজবংশের মহারাজাদের নির্মিত) কালী মন্দির এবং এটি ৫১টি শক্তিপীঠের একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। বহু বছর ধরে বর্গাভীমা মন্দিরে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং ওড়িয়া ভাষার একটি সাংস্কৃতিক মিশ্রণ প্রাধান্য পেয়েছে। দেবী বর্গাভীমার অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে প্রাচীন বন্দর শহর তাম্রলিপ্ত শহরটি তাদের দেবী দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং মন্দিরটি দেবতা বিশ্বকর্মার দ্বারা নির্মিত ছিল। পুরাণ অনুসারে, সতী/পার্বতীর বাম গোড়ালি এখানে পড়েছিল যখন ভগবান শিবকে শান্ত করার জন্য ভগবান বিষ্ণু দেবী সতীর পবিত্র দেহকে কয়েক টুকরো করে কেটেছিলেন। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে বহুবার এই মন্দিরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এটি একটি খুব পরিষ্কার এবং ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা মন্দির।
6. মুক্তিধাম
মুক্তিধাম মন্দিরটি ‘বিবেকানন্দ মিশন আশ্রম’ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দির কমপ্লেক্সে দেবী কালীর প্রধান মন্দিরের সাথে রাধা-কৃষ্ণ, হনুমানজির মূর্তি এবং দেবী কালীর পাদদেশে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদামণি এবং স্বামী বিবেকানন্দের ছবি রয়েছে। মূল মন্দিরের বিপরীতে রয়েছে শিব মন্দির। মন্দিরটি একটি সু-রক্ষণাবেক্ষণ করা ফুলের বাগান, লন, সবজির মাঠ ইত্যাদি দ্বারা বেষ্টিত। মন্দিরের প্রবেশদ্বারটি দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। ফটক ও মূল মন্দির সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত। ১৯৮৪ সালে বুদ্ধ পূর্ণিমায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল এবং ১৯৯৯ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মদিনে উদ্বোধন করা হয়েছিল।
7. মহিষাদল রাজবাড়ি
মহিষাদল রাজবাড়ি পূর্ব মেদিনিপুরের একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। সপ্তাহান্তের ছোট্ট ছুটিতে অনায়াসেই সকলে ঘুরে আসতে পারেন বা রাজারা কেমন করে থাকতেন তার একটা অভিজ্ঞতা পেতে পারেন।
মহিষাদল রাজবাড়ির ইতিহাস কিছুটা এরকম, ষষ্ঠদশ শতকে জনার্দন উপাধ্যায় প্রথম এই রাজবাড়িটি তৈরি করেছিলেন। বংশ পরম্পরায় সেই প্রাসাদ ধীরে ধীরে বড় হয়। মহিষাদল রাজবাড়িতে এখন তিনটি প্রাসাদ, যথাক্রমে রঙ্গিবসান, লালকুঠি এবং ফুলবাগ। কেবল মাত্র ফুলবাগেই পর্যটকরা থাকতে পারেন। সেই ফুলবাগই একদিনে দেখে শেষ করতে পারেন না পর্যটকরা। আবার প্রাসাদ কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে রয়েছে দীঘি, পুকুর, কুলদেবতা মদনগোপাল জিউয়ের মন্দির ছাড়াও দুর্গামণ্ডপ।
কলকাতা থেকে বম্বে রোড ধরে নন্দকুমার মোড় পার করে ৮ কিলোমিটার পরেই কাপাসিরিয়া মোড়। সেখান থেকে ৫ কিলোমিটার গেলেই মহিষাদল রাজবাড়ি। আবার কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে রায়চক তারপর রায়চক বা নূরপুর থেকে গঙ্গা পার হয়ে গেঁওখালি। গেঁওখালি থেকে মহিষাদল।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷