সারান্ডা ফরেস্ট ভ্রমণ: চলুন সাতশো পাহাড়ের দেশে

সারান্ডা ফরেস্ট

সারান্ডা ফরেস্ট আপনার পরবর্তী ভ্রমণ গন্তব্য হিসাবে অবশ্যই ভাবুন যদি অকৃত্রিম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আপনাকে টানে। সারণ্ডা বন যেটি অবস্থিত ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা রাজ্যের মধ্যে। এই বিশাল শালবনের মধ্যে লুকিয়ে আছে অসংখ্য উচ্ছল ঝর্ণা, অন্ধকার গুহা, আদিবাসী গ্রামের ঐতিহ্য, আর বন্যপ্রাণীর সমাহার। চলুন, একঝলকে দেখে নেওয়া যাক সারান্ডা ফরেস্ট’এর মায়াবী ভ্রমণের সম্ভাবনাকে। এখানে প্রায় ৭০০টি ছোট পাহাড় বা টিলা রয়েছে, যে জন্য এই বনকে “সাতশো পাহাড়ের দেশ” নামে ডাকা হয়।

কেন দেখবেন সারান্ডা ফরেস্ট ?

সারান্ডা ফরেস্ট
Picture credit : Ankita Sen

মুলত ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূম জেলায় অবস্থিত সারান্ডা ফরেস্ট বা সারণ্ডা বন। এখানে প্রায় ৭০০টি ছোট পাহাড় বা টিলা রয়েছে, যে জন্য এই বনকে “সাতশো পাহাড়ের দেশ” নামে ডাকা হয়। এটি ৮৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং এই বনের বেশ অনেকটা অংশ ওড়িশা রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত। এই দুই রাজ্য জুড়ে যমজ পাহাড় কিরিবুরু ও মেঘাতুবুরু ছড়িয়ে পড়েছে। ‘কিরি’ শব্দের অর্থ ‘হাতি’ এবং ‘বুরু’ শব্দের অর্থ ‘পাহাড়’। এইভাবে কিরিবুরু মানে ‘হাতির পাহাড়’ কারণ পাহাড়টি প্রচুর সংখ্যক বন্য হাতির আবাসস্থল। তেমনি মেঘাতুবুরু, ‘মেঘতুবুরু’ যার অর্থ ‘মেঘ’। বছরের বেশিরভাগ সময় এটি মেঘের ঘন স্তরের নীচে আবৃত থাকে বলে এটিকে যথার্থই ‘মেঘের পাহাড়’ বলা হয়। বর্ষায়, সারান্ডা ফরেস্টে ভারী বৃষ্টিপাত হয় যার কারণে মেঘাতুবুরুকে প্রায়শই ‘ঝাড়খণ্ডের চেরাপুঞ্জি’ নামেও সম্বোধন করা হয়।

কী দেখবেন সারণ্ডায়?

ঝর্ণা বা জলপ্রপাত:

পাচেরি ফলস
পাচেরি জলপ্রপাত

ঝরঝরে ঝর্ণার মতো সারান্ডা ফরেস্টের প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের অন্যতম উপায় হলো ঝর্ণা দেখা। মুরগা মহাদেব ফলস, ঝিকিরা, পাচেরি, পুঁডুল ইত্যাদি সারান্ডা ফরেস্টের সব ঝর্ণাই মনোমুগ্ধকর।

বন্যপ্রাণী:

সারান্ডার জঙ্গলে হাতি
সারান্ডার জঙ্গলে হাতি

সারণ্ডা বনে হাতি, চিতা, বনরুই, বন্য শুয়োর, হরিণ, মেয়ে হরিণ, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি সহ বিভিন্ন প্রাণী দেখা যায়। সারান্দার জঙ্গল হল বেশ কয়েকটি হাতির আবাস। যেমন ওড়িশার পার্শ্ববর্তী কেওনঝড় জেলা হাতিদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। তবে বন বিভাগের অনুমতি ও গাইডের সঙ্গে থাকা বাধ্যতামূলক

আদিবাসী গ্রাম:

আদিবাসী গ্রাম
সারান্ডার জঙ্গলে আদিবাসী গ্রাম

সারান্ডা ফরেস্টের আশেপাশে বিভিন্ন আদিবাসী গ্রাম রয়েছে। সেখানকার সংস্কৃতি ও জীবনধারা জানা একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এছাড়াও আপনি বনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ১,৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি নৈসর্গিক আদিবাসী গ্রাম থালকোবাদ পরিদর্শন করতে উপভোগ করতে পারেন।

অন্যান্য দর্শনীয় স্থান:

  • সারণ্ডা জঙ্গলে স্বপ্নেশ্বর মন্দির, কর্মাপদা গ্রাম, লেপার্ড গুহা, ভালু গুহা ইত্যাদি আরও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। মুরগা মহাদেব ওয়াটার ফলস আর মন্দির পাশাপাশি অবস্থিত। শ্রাবণ মাসে এবং চৈত্র মাসে এখানে বেশ বড়সড় মেলা বসে।
  • মিরিং শৃঙ্গার বিশালাকার পাথর যার উপরে অনেকগুলি বড় বড় ছাপ রয়েছে । স্থানীয়রা মনে করেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বনবাসের সময় এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের ধারণা এই ছাপ গুলো আসলে শ্রীরামচন্দ্র, লক্ষণ এবং হনুমানের পায়ের ছাপ ।
  • অসম্ভব সুন্দর সূর্যাস্ত ও সুর্যোদয় ভিউপয়েন্ট রয়েছে কিরিবুরু – মেঘাতিবুরুতে। এটি মিস একেবেরেই করা যাবে না।

কখন যাবেন সারণ্ডায়?

সারণ্ডা বনে ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো অক্টোবর থেকে মার্চ মাস। এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং বৃষ্টি কম হয়। তবে বর্ষাতেও জঙ্গল খোলা সমস্ত বনের রঙ হয় ঘন সবুজ। শুধু তাই নয়, তখন এখানকার জলপ্রপাতগুলির রূপও অসাধারণ হয়।

কিভাবে যাবেন সারণ্ডায়?

কিরিবুরু আর মেঘাতাবুরু হল ওড়িশা (কেওনঝড়) ও ঝাড়খণ্ডের (পশ্চিম সিংভূম) হাত ধরাধরি করে থাকা দু’টি যমজ জনপদ। যাওয়া ও আসার হাওড়া থেকে একমাত্র ট্রেন হাওড়া-বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস। আপ ১২০২১: ছাড়ে সকাল ৬টা ২০ ও বারবিল পৌঁছয় বেলা ১২টা ৫০ । ডাউন ১২০২২: বারবিল স্টেশন থেকে ছাড়ে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে ও পৌঁছয় রাত ৮টা ৫৫-তে)। সারান্ডা সফরে একমাত্র অনুমতিপ্রাপ্ত গাড়ি যায়, তাই বারবিলকে কেন্দ্র করে এই সফর করতে প্যাকেজে টুর করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

কোথায় থাকবেন?

সারণ্ডা বনের আশেপাশে বিভিন্ন রকমের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বন বিভাগের ফরেস্ট রেস্ট হাউস, হোটেল, রিসোর্ট ইত্যাদি থেকে পছন্দ মতো বেছে নিতে পারেন।

আরও পড়ুনঃ ঝাড়খণ্ডের ১৫টি বাছাই করা জায়গা সম্পর্কে জানুন

কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:

  • সারান্ডার জঙ্গলে প্রবেশের অনুমতিপত্র পাওয়া যায় মেঘাতাবুরুর বন দফতরের অফিস থেকে। এই অনুমতি পত্র ছাড়া জঙ্গলে প্রবেশ নিষেধ। সেজন্য চাই সচিত্র পরিচয়পত্র (আসল) ও একটা স্বপ্রত্যায়িত (সেল্ফ অ্যাটেস্টেড) ফোটোকপি।
  • কম খরচে ঘুরতে গেলে ছ’জনের দল করা ভাল। কারণ জঙ্গল সফর হয় শুধুমাত্র ছ’সিটের বোলেরোয়। বাজেট অনুসারে হোটেল বুকিং করলে অথবা প্যাকেজ নিলেও কম খরচে ঘুরে নেওয়া যায়।
  • জঙ্গলের গভীরে একা প্রবেশ করবেন না। এটি হাতি চলাচলের প্রধান পথ।
  • জঙ্গলে থাকা ওপেনকাস্ট লোহার খনির ছবি তোলাতেও বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়।
  • জঙ্গল ও জলপ্রপাত গুলিতে ঘোরাঘুরি করার জন্য উপযুক্ত জুতো পরুন।
  • মনে রাখবেন, সারান্ডা সফরে প্যাকড লাঞ্চ নিয়ে যেতে হয়। ভিতরে খাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই।
  • ঘোরার সময়- তিন রাত-চার দিন অথবা দু’রাত-তিন দিনেও ঘোরা যায়। দু’রাতের ক্ষেত্রে সারান্ডা সফর অধরা রয়ে যাবে।
  • পরিবেশ দূষণ রোধে প্লাস্টিকের ব্যাবহার এড়িয়ে চলুন।
  • স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখান।

আশা করি, এই সমস্ত তথ্য আপনাকে সারণ্ডা জঙ্গলে ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে সাহায্য করবে। প্রকৃতির কোলে পাহাড়, সবুজ বন, নির্মল ঝর্না ও সর্বপরি সরল সদাহাস্য মানুষগুলির সান্নিধ্যে হারিয়ে যাওয়ার এই অভিজ্ঞতা আপনার আজীবন মনে থাকবে।

Leave a Comment