কুলিক পাখিরালয়, যারা পাখি ভালোবাসেন অর্থাৎ খাঁচার বাইরে স্বাভাবিক বাসস্থানে পাখিদের নিজস্ব পরিমন্ডলে দেখতে ভালবাসেন বা ক্যামেরা বন্দি করতে উৎসাহী তাদের জন্য এই পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে একটি আদর্শ পক্ষীনিবাস রায়গঞ্জ বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য যাকে আমরা চিনি কুলিক পাখিরালয় নামে। এই অভয়ারন্যের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুলিক নদী, আর এই নদীর নাম থেকে এর নামটি এসেছে।
কুলিক পাখিরালয় কোথায়?
রায়গঞ্জ স্টেশন থেকে ৩৪ নং জাতীয় সড়ক ধরে কুলিক পাখিরালয় প্রায় ৩ কিমি। অভয়ারন্যের মুল আয়তন মোটামুটি ৩৫ একর, তবে আশেপাশের জায়গা নিয়ে প্রায় ২৮৬ একর জুড়ে পাখিরালয়ের অবস্থান। সমগ্র অঙ্কলের মধ্যে পত্র ১.৩ বর্গ কিলোমিটার হল কর এরিয়া আর বাকি অংশ বাফার জোন হিসাবে কাজ করে। এখানে প্রায় ১৬৪ টিরও বেশি প্রজাতির পাখির বাসস্থান। ১৯৭০ নগদ এখানে সামাজিক বনসৃজন সুরু হয় ঠিকই তবে, ১৯৮৫ সালে সৃজনকরা এই অরণ্যকে সরকারিভাবে রায়গঞ্জ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নামে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
কুলিক পাখিরালয় ভ্রমণের সেরা সময়
শীতকাল অর্থাৎ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী হল এখানে আসার অনুকুল সময়। তবে মনে হয় পাখি পর্যবেক্ষনের সবেচেয়ে ভাল সময় হল যখন নবজাত পাখিরা উড়তে শেখে। পাখিদের নিজস্ব জীবনযাত্রা দুরথেকে নিজের চোখে দেখার আনন্দই আলাদা। তাই অক্টোবর-নভেম্বর মাসে হল আদর্শ সময় ভালকরে দেখার বা যদি ফটোগ্রাফির নেশা থাকে তবে এই সময় কুলিক আপনার কাছে অত্যন্ত আনন্দের জায়গা।
সাধারনত জুন মাসের গোড়া থেকেই এখানে পরিযায়ী পাখিদের আসা শুরু হয়ে যায় এবং প্রায় এক লক্ষের কাছাকাছি সংখ্যায় এশীয় স্টর্ক প্রজাতির পাখিরা সাধারণত এখানে দলবদ্ধভাবে কলোনি তৈরি করে থাকে। তবে এশিয় স্টর্ক ছাড়াও এগ্রেট, লিটল কর্মোর্যান্ট, নাইট হেরন, পণ্ড হেরন ইত্যাদি পাখিগুলি জুলাই-আগস্টের মধ্যেই বাসা তৈরি করে। আগস্ট-সেপ্টেম্বর এই সময়টা তাদের প্রজননের।
কিভাবে যাবেন: রায়গঞ্জ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে
- রেলপথে যেতে চাইলে হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে উত্তরবঙ্গগামী ট্রেন ধরে রায়গঞ্জ স্টেশনে নামবেন। সেখান থেকে 4 কিলোমিটার দূরে গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন কুলিক পাখিরালয়।
- আকাশপথে গেলে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নামতে হবে। তারপর গাড়ি করে পাখিরালয় পৌঁছতে ৩-৪ ঘণ্টা লাগবে।
- সড়কপথে কলকাতা থেকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কুলিক পাখিরালয় সময় লাগবে ৫-৬ ঘণ্টা।
মালদা | ৭৫ কিলোমিটার |
বালুরঘাট | ১১০ কিলোমিটার |
শিলিগুড়ি | ১৮০ কিলোমিটার |
দার্জিলিং | ২৩৫ কিলোমিটার |
দুর্গাপুর | ৩১৫ কিলোমিটার |
আসানসোল | ৩২৭ কিলোমিটার |
কলকাতা | ৪২৫ কিলোমিটার |
থাকার ব্যবস্থা: কুলিক পাখিরালয়ে
রায়গঞ্জে আছে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ট্যুরিজম প্রপার্টি। কুলিক পাখিরালয় ‘য়ের উল্টোদিকেই WBTDCL-এর ‘দিনান্তে’ ( বুক করার জন্য এখানে ক্লিক করতে পারেন )। সেখানে কয়েকদিন পরিবার-বন্ধুবান্ধবের সাথে থেকে কুলিক পাখিরালয় এবং আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে দেখতে পারেন। এছাড়াও বেশ কিছু বেসরকারি হোম-স্টে বা হোটেল রয়েছে কুলিকের আশেপাশে। তবে সরকারি আবাসে থাকতে হলে মাস কয়েক আগে থেকে বুকিং করে নেওয়াই ভাল। এখানে মরশুমে ভিড় বেশি হয় পর্যটকদের তাই ঘর খালি পাওয়া দুস্কর।
আরও পড়ুন : সপ্তাহান্তে চলুন চুপির চর পাখিরালয়
ভ্রমণের অভিজ্ঞতা: কিভাবে ঘুরবেন কয়েকটা দিন
পাখিদের প্রাকৃতিক পরিবেশে দেখতে যদি আপনার ভালোলাগে তবে সারাটা দিন যে কিভাবে কেটে যাবে বুঝতেই পারবেন না। কুলিক পাখিরালয় ‘এর মধ্যে প্রচুর বড় বড় গাছ রয়েছে আর প্রতিটি গাছই যেন এক একটা পাখিদের কলোনী। সুন্দর সাজানো এই অরণ্য শান্ত কুলিক নদী হাজার হাজার পাখির উচু কাছের বাসায় আবার কখনও জলাশয়ে নেমে মাছ বা শামুক বা কাঁকড়া ইত্যাদি খাচ্ছে এসবের দৃশ্য আপনার ক্যামেরার সমস্ত জায়গা ভরিয়ে রাখবে।
এগুলো হেঁটে ছাড়াও দেখতে পারেন তা হল, এখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে, এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে জঙ্গলের সমস্ত গাছগুলি উপর থেকে দেখা যায়। প্রত্যেকটি গাছই উপর থেকে ধুসর-সাদা রঙে যেন রাঙানো । এই এশিয়াই সারস জাতীয় পাখিতে যেন ছেয়ে আছে। একটু নিরিবিলি যদি পছন্দের হয় তবে কয়েকটি দিন কাটিয়ে দিতে আপনার ঠিকানা হোক এই কুলিক পাখিরালয়।
খোলার সময়:
- রোজ সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে
- সোমবার পুরোপুরি বন্ধ থাকে
প্রবেশ মূল্য:
- প্রাপ্তবয়স্ক: ৪০ টাকা
- শিশু: ২০ টাকা
নৌকা ভ্রমণ:
- যদিও হেঁটে অবশ্যই দেখা যাবে তবে – অভয়ারণ্য ঘুরে দেখার সর্বোত্তম উপায় হল নৌকা করে ভ্রমণ।
- নৌকার টিকিট: ৫০ টাকা
দেখার মতো জিনিস:
- এশিয়ার বৃহত্তম ওপেন বিল স্টর্ক কলোনির তকমা রয়েছে এই কুলিকের।
- ওপেন বিলের পাশাপাশি নাইট হেরন, করমোরেন্ট এগরেটের মতো বিদেশি পাখি যেমন কুলিকের আকর্ষণ বাড়িয়েছে।
- একইভাবে প্রচুর দেশীয় পাখিরও কলকাকলি শোনা যায় এখানে।
- দারুন একটা ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে , যেখান থেকে পাখিরালয়ের সবথেকে ভাল ভিউ পাওয়া যায়।
- যে কৃত্রিম খাল কাটা হয়েছে কুলিক নদী থেকে সেটিকে পাখিরালয়ের প্রাণ বলা যেতে পারে ।
ভ্রমকারীদের প্রতি পরামর্শ :
- পাখি দেখার জন্য দূরবীন ব্যবহার করুন
- পাখি দেখতে ধৈর্য চাই, তাই অযথা অধৈর্য হয়ে জোরে জোরে কথা বলা, দৌড়-ঝাঁপ না করাই ভাল।
- পরিবেশের যত্ন নিন যাতে পাখিদের স্বাববিক জীবনে আমরা ব্যাঘাত সৃষ্টি না করি।
- শব্দ দূষণ এড়িয়ে চলুন
উপসংহার
কুলিক পাখিরালয় প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক স্বর্গ। শান্ত পরিবেশে পাখির কলকাকলি উপভোগ করার জন্য আদর্শ জায়গা। রিলাক্স করার এবং প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি অসাধারণ স্থান এই কুলিক পাখিরালয়। পাখি ছাড়াও রায়গঞ্জ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য গেলে শেয়াল, খরগোশ, বাঘরোল, বনবিড়াল, মেছো বিড়াল ও বিভিন্ন প্রজাতির সাপ দেখা যায় । এই অরণ্যে লম্বা লম্বা তাল গাছে ঝুলে থাকে অসংখ্য বাদুড়।
অবসর সময় কাটতে কিংবা মনের মানুষের সঙ্গে একটু নিরিবিলি সময় কাটাতেই কুলিক নদীর পাড়ে বসে কিংবা নদীর বুকে নৌকা বিহার করতে পারেন। কুলিকের পাশে থাকার ও বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে টুরিস্ট লজ-সহ বিভিন্ন বেসরকারি হোটেল- রিসর্ট গড়ে উঠেছে এই কুলিকে। শুধু কলকাতাই নয় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আজ ছড়িয়ে পড়েছে এই কুলিক পক্ষীনিবাসের নাম। সপ্তাহান্তে ছুটি কাটাতে বহু পর্যটকই ছুটে আসেন এই কুলিকে।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷