
ভারতের সাংস্কৃতিক গন্তব্য বলতে সমগ্র ভারতবর্ষকেই বোঝায়। প্রাণবন্ত ঐতিহ্য ও গভীর-মূল সাংস্কৃতিক বিস্ময়ের এই ভান্ডার আপনার ভ্রমণের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রাচীন শহরগুলি থেকে ইতিহাসের গল্প ফিসফিস করে, আধুনিক কেন্দ্রগুলি দেশের শৈল্পিক উজ্জ্বলতাকে উদযাপন করে, ভারতের প্রতিটি কোণ এক অনন্য অভিজ্ঞতা প্রদান করে। রাজকীয় দুর্গ, পবিত্র মন্দির, কোলাহলপূর্ণ বাজার বা গ্র্যান্ড উৎসব যাই হোক না কেন, এই সাংস্কৃতিক গন্তব্যগুলি দেশের আত্মার এক ঝলক প্রদান করে। এই বছরে আপনার অন্বেষণের জন্য ভারতের 12টি সেরা সাংস্কৃতিক গন্তব্য এখানে দেওয়া হলো।
ভারতের সাংস্কৃতিক গন্তব্য, সেরা 12 টির তালিকা
বহুমাত্রিক সংস্কৃতির দেশ এই ভারতের সাংস্কৃতিক স্থানগুলো প্রতি বছর হাজারো পর্যটকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। এই তালিকায় ভারতের ১২ টি জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক স্থানের উল্লেখ করা হয়েছে, যা দেশের অনন্য বহুসাংস্কৃতিক পরিচয়ের স্বাদ দেবে।
বারাণসী – ( Varanasi )

ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত বারাণসী হিন্দু ঐতিহ্য ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের এক অনন্য ক্ষেত্র। শহরের প্রাচীন গলিগুলোতে হাঁটলেই দেখা মেলে বিভিন্ন পবিত্র আচার-অনুষ্ঠানের। দশাশ্বমেধ ঘাটের গঙ্গা আরতি এক অভূতপূর্ব আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা যা মিস করা উচিত নয়। এছাড়াও, ঐতিহাসিক কাশী বিশ্বনাথ মন্দির দর্শনীয় স্থানের অন্যতম। বারাণসীর সংকীর্ণ গলিতে ছড়িয়ে থাকা রঙিন গয়নার দোকান ও সিল্ক তাঁতির দোকান ভারতীয় সংস্কৃতির এক ভিন্ন দিক তুলে ধরে।
দিল্লি – ( Delhi )

ভারতের রাজধানী দিল্লি প্রকৃত অর্থেই একটি সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের স্থান। আধুনিক শহরের পাশাপাশি এখানে রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী বহু স্মৃতিস্তম্ভ। লাল কেল্লা, অপূর্ব হুমায়ুনের সমাধি এবং আইকনিক ইন্ডিয়া গেট শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। দিল্লির সংস্কৃতি প্রাণবন্ত— ব্যস্ত বাজার, সবুজ উদ্যান এবং সুস্বাদু স্ট্রিট ফুড যা ভারতের সেরা খাবারের তালিকায় অন্যতম। লোটাস টেম্পল, জামে মসজিদ ও হাউজ খাস ভিলেজ দিল্লি ভ্রমণের সময় অবশ্যই দেখার মতো স্থান।
আরও পড়ুন: উত্তর প্রদেশের ১২ টি দর্শনীয় মন্দির সম্পর্কে জানুন
আমেদাবাদ – ( Ahmedabad )

ভারতের প্রথম ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিটি, আহমেদাবাদ স্থাপত্যের বিস্ময় যেমন সবরমতি আশ্রম, জটিল ধাপকুয়ো এবং পুরাতন শহরের মধ্য দিয়ে অত্যাশ্চর্য ঐতিহ্যবাহী হাঁটার পথের আবাসস্থল। এর টেক্সটাইল শিল্প এবং রন্ধনসম্পর্কিত আনন্দও এর সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিকে প্রতিফলিত করে।
লখনউ – ( Lucknow )

নবাবের শহর লখনউ তার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য এবং সুস্বাদু আওয়াধি খাবারের জন্য বিখ্যাত। রুমি দরওয়াজা, ভুলভুলাইয়া, বড় ইমামবাড়া ও ছোট ইমামবাড়া ভারতের ইসলামিক স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম নিদর্শন। লখনউ শহরের স্থানীয় রেস্তোরাঁ ও দোকানে পাওয়া কাবাব ও বিরিয়ানির স্বাদ অনন্য, যা অন্য কোথাও পুনরায় তৈরি করা সম্ভব নয়। আরও কিছু দর্শনীয় স্থান হলো হুসেনাবাদ ক্লক টাওয়ার ও ব্রিটিশ রেসিডেন্সি।
আরও পড়ুন: উত্তরপ্রদেশের 12টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ্যান
কলকাতা – ( Kolkata )

কলকাতাকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়, কারণ এখানে সর্বদা শিল্প ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার ঘটে। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এক অত্যাশ্চর্য স্থাপত্য যা লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো ও নানা প্রদর্শনীর মাধ্যমে ইতিহাসের কথা বলে। প্রিন্সেপ ঘাটের নৌবিহার গঙ্গার অপরূপ দৃশ্য উপভোগের সুযোগ করে দেয়। শহরের একটি কম পরিচিত কিন্তু আকর্ষণীয় স্থান হল চায়নাটাউন, যেখানে এখনও কিছু চীনা ভারতীয় নাগরিক বসবাস করেন; এখান থেকেই জনপ্রিয় ‘দেশি চাইনিজ’ খাবারের উৎপত্তি হয়েছে।
অমৃতসর – ( Amritsar )

অমৃতসর শিখ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে পবিত্র উপাসনালয় স্বর্ণমন্দিরের আবাসভূমি। এটি ভারতের অন্যতম ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক স্থান, যেখানে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম কমিউনিটি কিচেন (লঙ্গর)। এখানে সরল নিরামিষ খাবার পরিবেশন করা হয়, যার মধ্যে বিশেষ ‘প্রসাদ’ (গুরুদের আশীর্বাদপুষ্ট মিষ্টি খাবার) দেশের সর্বত্র জনপ্রিয়। শহরটি জলিয়ানওয়ালা বাগের জন্যও প্রসিদ্ধ, যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এছাড়াও, ওয়াঘা সীমান্তের কুচকাওয়াজ প্রদর্শনী, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের সেনারা অংশগ্রহণ করে, একটি দেশপ্রেমে ভরা অভিজ্ঞতা যা পর্যটকদের জন্য অবশ্যই উপভোগ্য।
পুদুচেরি – ( Puducherry )

পুদুচেরি, যা পূর্বে পন্ডিচেরি নামে পরিচিত ছিল, ভারতের অন্যতম অনন্য সাংস্কৃতিক স্থান। এখানকার ফরাসি ঐতিহ্য ও তামিল সংস্কৃতির সংমিশ্রণ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা প্রদান করে। কেন্দ্রশাসিত পুদুচেরি অঞ্চলটি শান্ত সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত, যা নিরিবিলি ছুটির জন্য আদর্শ। ফরাসি কোয়ার্টার ঘুরে দেখলে এখানকার চমৎকার ভিলা ও স্টাইলিশ বুটিকগুলোতে ফরাসি ঐতিহ্যের স্বাদ পাওয়া যায়। এছাড়াও, স্যাক্রেড হার্ট ব্যাসিলিকা, শ্রী অরবিন্দ আশ্রম ও অরোভিল পুদুচেরির অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গের ভ্রমণযোগ্য 12টি ঐতিহাসিক স্থান
কেরালা ব্যাকওয়াটার (Backwaters, Kerala)

কেরালা ব্যাকওয়াটার ভারতের সবচেয়ে অনন্য পরিবেশগত অঞ্চলের মধ্যে একটি, যেখানে আরব সাগরের লবণাক্ত জল ও নদীর মিষ্টি জল মিলিত হয়ে বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের আবাস গড়ে তুলেছে। এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় আকর্ষণ হাউসবোট, যা ভাসমান বাড়ির মতো এবং ভারতীয় সংস্কৃতির এক বিশেষ অভিজ্ঞতা প্রদান করে। পর্যটকরা নৌকার ওপর থেকে স্থানীয় সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নিতে নিতে জেলেদের ও কৃষকদের জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করতে পারেন। কেরালার ঐতিহ্যবাহী নৃত্য “কথাকলি” দেখার জন্য কোচি শহর ভ্রমণ করা যেতে পারে; এটি অত্যন্ত বর্ণিল পোশাক ও চিত্তাকর্ষক মেকআপের জন্য পরিচিত।
রাজস্থান – ( Rajasthan )

রাজস্থান ভারতের অন্যতম সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ রাজ্য, যেখানে অগণিত দুর্গ ও প্রাসাদ রয়েছে যা অতীতের রাজা-রানীদের গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। জয়পুর, উদয়পুর ও জোধপুরের প্রাসাদ ও স্থাপত্যশৈলী পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এসব রাজকীয় স্থানের প্রবেশপথের কাছাকাছি রাস্তায় ঐতিহ্যবাহী গয়না, চিত্রকর্ম ও কাপড়ের দোকান দেখা যায়, যা একেবারেই অনন্য। এই অঞ্চলের বিশেষ নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশনা উপভোগ করা যায় বিভিন্ন স্থানে। জয়পুরের গোলাপি হাওয়া মহল এক অপূর্ব স্থাপত্য, যা অবশ্যই দেখতে হবে। চলচ্চিত্রপ্রেমী বিশেষত বাংলা সিনেমার অনুরাগীদের জন্য জয়সালমের এক বিশেষ আকর্ষণ হলো “সোনার কেল্লা” (গোল্ডেন ফোর্ট), যেখানে সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র “সোনার কেল্লা” চিত্রায়িত হয়েছিল।
অজন্তা ও ইলোরা গুহা (Ajanta & Ellora caves)

ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে খুব কম স্থানই অজন্তা-ইলোরার সমকক্ষ হতে পারে। মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলায় অবস্থিত, ইলোরা গুহা হলো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ হিন্দু মন্দির গুহা কমপ্লেক্স, আর অজন্তা গুহাগুলি বৌদ্ধ গুহা স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে পরিচিত। এখানকার শৈল্পিক চিত্রকর্ম, পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্য ও প্রাচীন মঠ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। ইলোরা গুহায় ভারতীয় দুটি মহাকাব্যের (রামায়ণ ও মহাভারত) বিভিন্ন দৃশ্য খোদাই করা হয়েছে, যা দর্শনার্থীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা প্রদান করে।
তাঞ্জাভুর – (Tanjore, Tamil Nādu)

তামিলনাড়ু রাজ্যে অবস্থিত তাঞ্জাভুর ভারতের অন্যতম বিশেষ সাংস্কৃতিক স্থান। এখানে অবস্থিত বৃহদেশ্বর মন্দির চোল রাজবংশের স্থাপত্যশৈলীর এক অসাধারণ নিদর্শন, যা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। তাঞ্জাভুর মারাঠা প্রাসাদে অবস্থিত সারস্বতী মহল হলো এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থাগার, যেখানে বহু দুর্লভ পান্ডুলিপি ও পুস্তক সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া, বিখ্যাত তাঞ্জোর চিত্রকর্ম, যা স্বর্ণের পাত ব্যবহার করে তৈরি করা হয়, স্থানীয় দোকানগুলোতে পাওয়া যায়। এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে কলাপাতায় পরিবেশিত তামিল খাবার বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
হাম্পি – (Hampi, Karnataka)

আমরা যখন কর্ণাটকের দক্ষিণে যাত্রা করি, তখন আমরা হাম্পির ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের মুখোমুখি হই, যা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। একসময় শক্তিশালী বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী, হাম্পি এখন ইতিহাস ও শিল্পের এক আকর্ষণীয় উন্মুক্ত জাদুঘর।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, চিত্তাকর্ষক মন্দির, রাজকীয় বেষ্টনী এবং রাজকীয় স্মৃতিস্তম্ভ আবিষ্কার করুন যা আপনাকে সময়ের পিছনে নিয়ে যায়। ভিত্তালা মন্দির, এর বিখ্যাত পাথরের রথ এবং সঙ্গীত স্তম্ভগুলির জন্য বিখ্যাত, সেই যুগের উজ্জ্বল স্থাপত্য প্রদর্শন করে। লম্বা বোল্ডার এবং সবুজ গাছপালা সমন্বিত হাম্পির আকর্ষণীয় ল্যান্ডস্কেপ, এর চিরস্থায়ী আকর্ষণ যোগ করে।

প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷