পূর্বস্থলী বা চুপির চর বা কাষ্ঠশালী যে নামেই ডাকুন, জায়গাটা কিন্তু সুন্দর। চলুন কলকাতা থেকে ঘন্টা তিনেকের দুরত্বে একটা সপ্তাহান্তে ছুটি কাটানর জন্য দারুন জায়গা। নৌকায় চড়ে পাখি দেখতে, জমিয়ে পিকনিক করতে বা গ্রাম বেড়াতে চলুন পূর্বস্থলী। পাখিদের মুক্ত পরিবেশে বিচরন দেখতে যদি ভাল লাগে তবে জঙ্গলের মধ্যে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে পাখি দেখতে দেখতে নিজেকে সেলিম আলি ভাবা বেশ রোমাঞ্চকর। পাখিদের নিজস্ব আচরন বা তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে পর্যবেক্ষন করা এবং অনেক দুর্লভ পাখিদের স্বচক্ষে দেখার তৃপ্তিই আলাদা।
নদিয়া-বর্ধমান সীমান্তের কাছে ভাগীরথীর একটি শাখা মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্বস্থলীর কাষ্ঠশালীতে তৈরি করেছে এই বিশাল অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ, এলাকায় যার নাম ছাড়িগঙ্গা৷ বছর ত্রিশেক ধরে এই হ্রদ পরিযায়ী পাখিদের আস্তানা৷ ওই হ্রদেই চোখে পড়তে পারে ফ্রান্স ও পর্তুগাল থেকে আগত পাখি পার্পল মুরহেন, বাংলায় আমরা যাকে বলি কামপাখি। ইউরোপের নানা অঞ্চল থেকে আসে লিটল গ্রিব বা ডুবুরি পাখির।
পূর্বস্থলী কিভাবে যাবেন
আপনি কলকাতা থেকে ট্রেন, বাস এবং গাড়িতে সহজেই পুর্বস্থলী, চুপির চর পৌঁছাতে পারেন।
- ট্রেনে – পুর্বস্থলী যাওয়ার একটি সেরা ট্রেন হলো হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া লোকাল। এই ট্রেনে আপনি প্রায় আড়াই ঘন্টার মধ্যে পুর্বস্থলী স্টেশন পৌঁছে যাবেন।
আপনি স্টেশন এলাকা থেকে একটি টোটো ভাড়া করে চুপির চরে যেতে পারেন। এটি ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বেশি সময় নেবে না। ভাড়া ২০-৩০ টাকা। - বাসে – আপনি কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অংশ থেকে নবদ্বীপ বা মায়াপুর যাওয়ার যেকোনো বাস ধরতে পারেন। এরপর সেখান থেকে পুর্বস্থলী পৌঁছানো যায়।
- গাড়িতে – সড়কপথে কলকাতা থেকে পূর্বস্থলী ১২০-১৩০ কিলোমিটার। নিজেদের গাড়িতে গেলে ব্যারাকপুর এবং কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ঈশ্বর গুপ্ত সেতু পেরিয়ে চলে আসুন ত্রিবেণী। তারপর সপ্তগ্রাম-ত্রিবেণী-কালনা-কাটোয়া রোড ধরে কালনা, ধাত্রীগ্রাম, সমুদ্রগড় হয়ে চলে আসুন পুর্বস্থলী। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সরণী ধরে এই যাত্রাও কম আকর্ষণীয় নয়। যাওয়া বা আসার পথে বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরটি দেখে নিতে পারেন। এভাবে গাড়িতে কলকাতা থেকে পুর্বস্থলী পর্যন্ত আসাটাই একটা দারুন রোড ট্রিপ হতে পারে।
সুন্দরী পূর্বস্থলীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য
অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বা “চুপির চর” হল চুপি ও কাষ্ঠশালী গ্রামগুলি কাছেই বয়ে যাওয়া ভাগিরথী বা গঙ্গা থেকেই সৃষ্ট। চুপির চরের স্বচ্ছ জল, বিস্তীর্ণ উর্বর জমির ফলের বাগান ৭৫টিরও বেশি প্রজাতির স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখিদের আশ্রয় প্রদান করে। গ্রামের পথে ধান, সরষে, সবজি ক্ষেত বা ফুলের বাগানের ধার ধরে হাঁটুন। ফুসফুসের দূষণমুক্তি ঘটবে। মন চাইলে ছিপ নিয়ে বসে যান হ্রদের ধারে।
শুধু শীতেই তো নয়, পুর্বস্থলী যাওয়া যায় বছরভরই। হ্যাঁ শীতের মরশুমে পুর্বস্থলীর বিশেষ আকর্ষণ ওই পরিযায়ী পক্ষীকুল। অন্য মরশুমেও পুর্বস্থলী যথেষ্ট আকর্ষণীয়। শান্ত পুর্বস্থলীর সবুজ খেতে ভাগীরথী থেকে আসা নির্মল বাতাস ঢেউ খেলে যায় গ্রীষ্মে। অনেক পাখি তখনো থাকে। দেশীয় পাখিকুলের দেখা মিলবে জলে, গাছে, ক্ষেতে । পাখিরা নিশ্চিন্তে অভয়ে এখানে থেকে যায় প্রায় সারা বছর। বর্ষায় বিশাল হ্রদ জুড়ে বৃষ্টিপাতের দৃশ্য অনির্বচনীয় এক দৃশ্যপট রচনা করে।
আরেকটা কথা, পুর্বস্থলীতে বিঘের পর বিঘে জমি জুড়ে দারুন সব আমের বাগানগুলিতে স্বাদে-গন্ধে অতি উন্নত গুণমানের আম্রপালী, রানি, হিমসাগর, ল্যাংড়া ইত্যাদি আম হয়। রাজ্য আম উৎসবে পূর্বস্থলীর আম রসিকজনের মন কেড়ে নেয়। ওই পাকা আমের টানেও গ্রীষ্ম-বর্ষায় কত পাখি ডেরা বাঁধে পুর্বস্থলীতে।
পূর্বস্থলী ঘুরে দেখার সেরা সময়
পুর্বস্থলীর এই পাখিরালয় সারা বছরই খোলা থাকে তবে সাধারণত নভেম্বর মাস থেকে এই চুপির চরে পাখি আসতে শুরু করে। মাঝ-নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক পাখি দেখার সুযোগ থাকে। তারপর পরিযায়ী পাখিরা ফিরতে শুরু করে।
অর্থাৎ যদি অনেক পরিযায়ী দেখার হয় তবে ওই মিড-নভেম্বর থেকে মিড-ফেব্রুয়ারি কিন্তু প্রচুর দেশীয় পাখি সারা বছর এখানে থাকে। সত্যি বলতে কি চুপির চর একটা দারুন পিকনিক স্পট সাথে বিভিন্ন ঋতুতে হ্রদে নৌকা বিহার আপনাকে বারবার আসার আমন্ত্রন জানাবে।
পূর্বস্থলীতে কি কি করবেন
- আমার মনে হয় কাছ থেকে পাখি দেখতে ও ফটো তুলতে দাঁড়-টানা নৌকায় চড়ে হ্রদের বুকে ভেসে পড়ুন। অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের কোন কোন এলাকায় কোন কোন পাখি দেখার সম্ভাবনা বেশি তা মাঝিরাই ভালো জানেন। এক একটি নৌকায় দুজন করে চড়তে পারবেন। ভাড়া ঘন্টাপিছু ১৫০ টাকার মত। হ্রদের পাড় থেকেও পাখি দেখা যেতেই পারে। তবে নৌকায় চড়ে হ্রদের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কাছ থেকে পাখি দেখা বা ছবি তোলার রোমাঞ্চ ও মজাটাই অন্যরকম।
- আশেপাশের কৃষিজমি এবং ফলের বাগানগুলি ঘুরে দেখবেন।
- সকালে চুপি চরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে সুন্দর সূর্যোদয় এবং বিকালে হ্রদের পূর্ব প্রান্ত থেকে সূর্যাস্ত দেখতে মিস করবেন না।
- হ্রদে নৌকা নিয়ে প্রিয়জনের সাথে এই জলবিহার আপনার হ্রিদয়ে অনেকদিন থাকবে।
- যেমনভাবে মন চায় প্রকৃতির অপরূপ ছবি তুলুন ।
- বাচ্চাদের সাথে নিয়ে শিশু উদ্দানে যান এবং ওয়াচ টাওয়ার থেকে মোহময় প্রকৃতির সৌন্দৈর্যের রস আস্বাদন করুন
পূর্বস্থলীতে থাকার জায়গা
চুপির হ্রদের পাড়েই সুসজ্জিত উদ্যানের মধ্যে রয়েছে চুপি কাষ্ঠশালী পাখিরালয়ের সমস্ত সুবিধাযুক্ত চারটি গার্ডেন কটেজ ও দুটি ম্যাঙ্গো অর্চার্ড কটেজ। রয়েছে চিলড্রেন্স পার্ক, ওয়াচটাওয়ার। সমস্ত কটেজেরই অবস্থান লেকের ধারে। ২ জন একটি ঘরে থাকলে সারাদিনের খাওয়াদাওয়া-সহ দিনপ্রতি মাথাপিছু খরচ ১৪৪০ টাকা। একটি ঘরে ৩ জন থাকলে খাওয়াদাওয়া-সহ দিনপ্রতি মাথাপিছু খরচ ১২৪৫ টাকা। গ্রীষ্মে এসি নন-এসি, দুই রকমের কটেজ-ই পাওয়া যাবে। এসি ঘরের ভাড়া সামান্য বেশি। ৩ থেকে ১০ বছর বয়সের বাচ্চাদের জন্য খরচে অনেকটাই ছাড় আছে। ৩ বছরের নীচের শিশুদের জন্য কোনও খরচ লাগে না।
পূর্বস্থলী ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস (BDO), কাষ্ঠশালী গ্রাম পঞ্চায়েত এবং কয়েকটি আশেপাশের ক্লাব যৌথভাবে এই বাসস্থান টি প্রতিষ্ঠা করে।
যোগাযোগের নম্বরঃ ৯০৭৩৫-৬৫৭২৩
পূর্বস্থলীর কাছাকাছি অন্যান্য আকর্ষণ
পূর্বস্থলীতে থাকার জায়গা বেশ ভাল তাই এখানে থেকেই কাছাকাছি বেড়িয়ে নেওয়া যায় কয়েকটি দর্শনীয় জায়গা। যেমন, শ্রীবাটি। শ্রীবাটিতে ১৮০২ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে টেরাকোটা শৈলীতে তৈরি মন্দিরগুলিতে নানা দেবদেবী, যুদ্ধের দৃশ্য, তৎকালীন প্রাত্যহিক জীবনের নানা ছবির মোটিফ-সহ আসাধারণ সব প্যানেল দেখতে আপনার নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। বেশিরভাগ মন্দিরেরই ভগ্নদশা। যে কয়েকটি মন্দির এখনো টিকে আছে, সেগুলির দেওয়ালের সূক্ষ্ম কাজ অতীতের শ্রীবাটির অনন্য টেরাকোটা কাজের সাক্ষ্য বহন করছে। পূর্বস্থলী থেকে শ্রীবাটি ২৫ কিলোমিটার।
এছাড়া পুর্বস্থলী থেকে মায়াপুরের ইস্কন মন্দির ও নবদ্বীপ মাত্র ১৫ কিলোমিটার। পূর্বস্থলীর কাছেই বাংলার ঐতিহ্যশালী কাঠের পুতুল তৈরির জন্য বিখ্যাত নতুনগ্রাম থেকেও বেড়িয়ে আসা যায়। নতুনগ্রামে কাঠিয়াবাবার আশ্রম এবং কাছাকাছি কপিল মুণির আশ্রম দর্শন করে আসতে পারেন।
আপনি যদি ফটোগ্রাফি প্রেমী হন তবে পুর্বস্থলীর মত এই জায়গাটিও আপনার জন্য আদর্শ। আপনি এখানে পুতুল এবং মডেল তৈরিতে নিযুক্ত গ্রামীণ সম্প্রদায়ের উপর অত্যাশ্চর্য কিছু ছবি তুলতে পারেন।
পুর্বস্থলী থেকে মাত্র ৩০কিমি দূরে কালনা রাজবাড়ী ও সংলগ্ন ঐতিহাসিক মন্দির সম্পর্কে পড়ুন ও ঘুরে আসুন।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷
Very informative post. Loved the place