অগ্রদ্বীপ গোপীনাথের মেলা হল এমন একটি উৎসব যেখানে ভক্তরা বিশ্বাস করেন ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়। ভক্তের শুধু বোঝাই বয়ে যান তাইই নয়, স্বয়ং ভগবান মর্ত্যে আসেন ভক্তের শ্রাদ্ধ করতে। পূর্ব বর্ধমানের ক্ষুদ্র জনপদ অগ্রদ্বীপ। এখানেই রয়েছে ৫০০ বছরের পুরনো গোপীনাথ মন্দির। প্রতি বছর চৈত্র মাসে দোল পূর্ণিমার পরের কৃষ্ণা একাদশীতে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে এক বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলাকে কেন্দ্র করে অগ্রদ্বীপ এবং তার চার পাশের দু-তিন কিলোমিটার এলাকা একটা মিলনতীর্থের চেহারা নেয়। লক্ষ লক্ষ লোক এই মেলাস আসেন। ভাবা যায়, এই মেলার আয়োজন করা হয় শ্রাদ্ধ দিবস উপলক্ষ্যে
অগ্রদ্বীপ গোপীনাথের মেলার ইতিহাস
জনশ্রুতি এই যে, পঞ্চদশ শতকের প্রথম দিকে শ্রীচৈতন্য দেব অগ্রদ্বীপে তাঁর ভক্ত গোবিন্দ ঘোষের কাছে এসে ছিলেন। এখানেই শ্রীচৈতন্য দেব একটি শ্রীকৃষ্ণের মুর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর নাম দেন গোপীনাথ এবং ওই মন্দিরের দায়িত্ব ভার গোবিন্দ ঘোষের হাতে দিয়ে তিনি নীলাচলে প্রস্থান করেন। গোবিন্দ ঘোষ ছিলেন ভগবান গোপীনাথের একনিষ্ঠ সেবক। অনেকে মনে করেন ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে চৈত্রের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে মারা গিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যের একনিষ্ঠ ভক্ত ও পার্ষদ গোবিন্দ ঘোষ। সেই তিথিকে স্মরণে রাখতে প্রতি বছর এই তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় গোবিন্দ ঘোষের পারলৌকিক বা চিড়ে মহোৎসব।
স্বয়ং গোপীনাথ এক মাস ধরে সমস্ত অশৌচ কার্যাদি যেমন হবিষ্যান্ন গ্রহণ বা কাছা ধারণ সবই করেন। গোবিন্দ ঘোষের পারলৌকিক ক্রিয়ায় পিণ্ডদানের জন্যই এই আয়োজন। জনশ্রুতি আছে, ৫ বছরের শিশুপুত্রের মৃত্যুর পরে শোকে পাগলের মতো অবস্থা হয়েছিল গোবিন্দ ঘোষের। তখন গোপীনাথ তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং তিনিই পুত্র হিসেবে গোবিন্দ ঘোষের শ্রাদ্ধ করবেন বলে তাঁকে আশ্বাস দেন। সেই কথা মেনেই গোবিন্দ ঘোষের মৃত্যুর পরে তাঁর শ্রাদ্ধ করেন গোপীনাথ। অনেকে বলেন, একমাত্র এখানেই নাকি ভগবান ভক্তের শ্রাদ্ধ করেন। সেই প্রথা সমানে চলছে এই অগ্রদ্বীপ গোপীনাথের মেলা।
অগ্রদ্বীপের ইতিহাস
জনশ্রুতি অনুযায়ী শ্রীচৈতন্যর আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই এই উৎসব চলে আসছে। বারুণীর স্নান উৎসবের জন্য অগ্রদ্বীপের যথেষ্ট নামডাক ছিল। চৈত্র মাসে কৃষ্ণ পক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে বারুনি স্নান হয়। বাংলা, বিহার বা ঊড়িস্যার নানা প্রান্ত থেকে মানুষ অগ্রদ্বীপে বারুণীর স্নানে সামিল হতে আসতেন। শোনাযায় আঠারো এবং উনিশ শতকে গঙ্গাসাগর মেলার চেয়েও অগ্রদ্বীপের বারুণীর স্নানের সুখ্যাতি ছিল। এখানেও গঙ্গাবক্ষে সন্তান বিসর্জন দেওয়ার রীতি ছিল।
গোপীনাথের মেলা
অগ্রদ্বীপ গোপীনাথের মেলার রাস্তার দুদিকে বড় বড় প্যান্ডেলে না না মতের ভক্তদের সমাবেশ। ভক্তরা এখনও গোপীনাথের এই লীলা দেখতে আসেন। প্রচলিত নিয়ম মেনে আগত পুন্যার্থিদের সঙ্গে গ্রামবাংলার মানুষও এ দিন অরন্ধন পালন করেন। আর অন্ন মোচ্ছবের সমস্ত প্যান্ডেলেই খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। খুব আড়ম্বর কিছু না হলেও খাবারের অভাব নেই। কে বা কোথা থেকে এসেছে, এসব প্রশ্ন কেউই করেন না। ভক্তরা আসছেন আর যে যেখানে খুশি বসে যাচ্ছেন। এ এক অন্য রকম পরিবেশ, সত্যই অনন্য। মেলার দ্বিতীয় দিনে এখানে অন্ন মহোৎসব হয় এবং তৃতীয় দিনে গঙ্গা স্নান হয় আর চতুর্থ বা শেষ দিন পালিত হয় গোপীনাথের দোলের মধ্য দিয়ে।
তবে সাধানরত যেকোন গ্রামীণ মেলাতে যেমন হয় গ্রামের ঘরোয়া বা প্রয়োজনীয় জিনিষের দোকান যেখানে বিক্রি হচ্ছে লোহার কড়াই, হাতা, খুন্তি বা সাঁড়াশি ইত্যাদি।আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ করা উচিৎ, সেটা হল – আপনারা যারা অন্যান্য মেলায় যেমন এই অগ্রদ্বীপ গোপীনাথের মেলা বা শান্তিপুরের রাস উৎসব বা কেন্দুলীর জয়দেবের মেলা এমনকি গঙ্গাসাগরের মেলাতে কোন না কোন সময় গিয়েছেন, লক্ষ করবেন উল্লেখিত সমস্থ মেলাতেই অগ্রদ্বীপ অর্থাৎ নূতনগ্রামের নাম উঠে আসবেই একটি পন্যের হাত ধরে, তা হল, কাঠের পেঁচা, গৌর-নিতাই বা বর-বৌ।
কিভাবে যাবেন গোপীনাথের মেলা
হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া লোকালে সোজা অগ্রদ্বীপ স্টেশন। স্টেশন থেকে মিনিট কয়েক হাঁটলেই অটো বা টোটোর স্ট্যান্ড সেখান থেকে ১৫ মিনিটের রাইডে সোজা অগ্রদ্বীপ গোপীনাথের মেলা প্রাঙ্গন ।
দেখলেন তো গোপীনাথের মেলা ও তাঁর ইতিহাস, এবার পড়ুন জয়দেব কেঁদুলি মেলা কেমন বা কবে ও কোথায় হয়।
প্রশ্নোত্তরে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য
অগ্রদ্বীপের মেলা কবে ?
চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে অগ্রদ্বীপ গোপীনাথের মেলা বসে।
অগ্রদ্বীপ গোপিনাথ মন্দির
অগ্রদ্বীপে শ্রীচৈতন্য প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের দেবতা শ্রীকৃষ্ণকেই গোপীনাথ নামে পরিচিত।
গোবিন্দ ঘোষের গোপীনাথ কে ?
গোবিন্দ ঘোষ গোপীনাথের সেই একনিষ্ঠ সেবক যাকে গোপীনাথ কথা দিয়েছিলেন ভক্তের মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানের দায়িত্ব পালন করবেন।
গোবিন্দ ঘোষ কে ?
গোবিন্দ ঘোষ শ্রীচৈতন্য দেবের অষ্ট পার্ষদের অন্যতম একজন ছিলেন।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷