গঙ্গাসাগর মেলা – উৎসব, ইতিহাস, সময়, আকর্ষণ

গঙ্গাসাগর মেলা

গঙ্গাসাগর মেলা আবার গঙ্গা সাগর যাত্রা বা গঙ্গা স্নান নামেও পরিচিত। ভারতবর্ষের নানা স্থানের বিভিন্ন ধরনের উৎসব ঐতিহ্য ও আনন্দের সঙ্গে পালিত হয় । তবে তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি উৎসব এমন আছে যেখানে দেশের সব প্রান্তের লোকজন একসাথে মিলেমিশে একটি উৎসব শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে আর সেটা যেন একটা বিশাল দেশের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ হয়ে দাঁড়ায়। গঙ্গাসাগর মেলা ঠিক সেই রকম একটি উৎসব। গঙ্গাসাগর মেলা যেখানে শুধু সমগ্র দেশ নয় সারা বিশ্ব থেকে হাজার হাজার তীর্থযাত্রীরা আসেন।

গঙ্গাসাগর মেলা কখন ও কোথায় হয়?

গঙ্গাসাগর মেলা প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির সময় হয়। পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ অঞ্চলে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি নাগাদ শুরু হয় । এটি মকর সংক্রান্তির দিনের আগের দিন থেকে শুরু হয় অর্থাৎ দুই দিন ব্যাপি হয়ে থাকে। তীর্থযাত্রা যদিও শুরু হয় আরও আগে থেকে। মকর সংক্রান্তিতে সুর্য্য প্রনাম করার সময় সকালে গঙ্গার পবিত্র জলে ডুব দেওয়া।

সাগর মেলা

সাগর মেলা পুর্ন ধর্মিয় রীতি মেনে পালিত হয়

গঙ্গাসাগর বা সাগর মেলা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে পুর্ন ধর্মীয় রীতি মেনে পালিত হয়। এখানে সংক্রান্তির দিনে, সমগ্র দেশ থেকে কয়েক লক্ষ তীর্থযাত্রী আসেন এবং মেলায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। বিদেশীরাও এই ধরনের মেলা দেখাকে যথেষ্ঠ আকর্ষণীয় বলে মনে করেন। এই সংস্কৃতির মহামিলন ক্ষেত্রে বহু মানুষ আত্মিক শান্তি পেতে দূর দুরান্ত থেকে ছুটে আসেন।

গঙ্গাসাগরে মকর স্নানের ইতিহাস

কপিল মুনির আশ্রম

হিন্দু ধর্মানুসারে, একবার রাজা সাগর অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র সাগর রাজার অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া চুরি করে বেঁধে রাখেন পাতাললোকে। সাগর রাজ যখন তাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া খুঁজতে আসেন, তখন তাকে খুঁজে পান কপিল মুনির আশ্রমের পাশে। রাজা সাগর মনে করেন, কপিল মুনি তাঁর যজ্ঞের ঘোড়া চুরি করেছেন। রাজার মনের কথা জানতে পেরে কপিল মুনি রেগে যান এবং রাজাকে ভষ্মীভূত করে দেন।

সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়

এরপর রাজা সাগরের বংশের পরবর্তী প্রজন্ম ভগীরথ, মহাদেবের আরাধনা করেন এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করে গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে মর্তে নিয়ে আসেন। গঙ্গার সেই পবিত্র জলস্পর্শে সাগর বংশের ভষ্মীভূত সন্তানরা নিজেদের জীবন ফিরে পান এবং তাঁরা নির্দ্বিধায় স্বর্গে গমন করেন। সেই থেকে এই গঙ্গাসাগর মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পূ্ণ্যার্থীরা হাজির হন। গঙ্গাসাগরে ডুব দিলে সমস্ত পাপ ধুয়ে তাঁরা স্বর্গে যেতে পারবেন বলে মনে করেন। সেই কারণেই কথিত যে “সব তীর্থ বার বার, গঙ্গাসাগর একবার”।

সাগর মেলা – এক কথায়

মা গঙ্গা হিন্দু ধর্মানুসারে পবিত্রতম নদী । বলা হয় যে তার কোলে একটি পবিত্র ডুব আপনার সমস্ত পাপ স্খলন করে। গঙ্গাসাগর মেল শীতকালে অনুষ্ঠিত হয়। গঙ্গার জল সাথে ঠান্ডা হাওয়া বয় কিন্তু ভক্তরা তখনও নবউচ্ছাস খুঁজতে এই ঠাণ্ডা জলে ডুব দেয় – তাঁরা বিশ্বাস করেন এটি বছরের সবচেয়ে শুভ দিন। গঙ্গাসাগর মেলাকে মানব ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমজমাট মেলা হিসাবে গণ্য করা হয় (কুম্ভ মেলায় ভারতে সর্বাধিক সংখ্যক তীর্থযাত্রী থাকে বলে মনে করা হয়) ।

গঙ্গাসাগর মেলায় কিভাবে পৌঁছাবেন

6 gangasagar crowd

গঙ্গাসাগর মেলায় যোগ দেওয়ার জন্য, আপনাকে প্রথমে সাগরদ্বীপ পৌঁছাতে হবে যা কলকাতা থেকে মাত্র ১২৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মেলা প্রাঙ্গণ কলকাতা বা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে ভালভাবে সংযুক্ত। আপনি এই পথে মোটামুটি বাধাহীন ভাবেই সাগরদ্বীপে পৌঁছাতে পারেন:-

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য ট্রেন হাওড়া স্টেশনের সাথে সংযোগ করছে। তাই হাওড়া স্টেশনে পৌঁছতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। প্রচুর স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন বা এমনকি ব্যক্তিগত পরিবহন অপারেটর রয়েছে যারা আপনাকে গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারে যদি আপনি হাওড়া স্টেশন বা আউট্রামঘাট বা কলকাতার এসপ্ল্যানেডে পৌঁছান

বাস অথবা গাড়িতে:

কলকাতা থেকে গঙ্গাসাগরের যাত্রাপথ বেশ দীর্ঘ। প্রথমে বাবুঘাট থেকে কাকদ্বীপ যাওযার বাস ধরতে হবে, অথবা এসপ্ল্যানেড বাস টার্মিনাস থেকে কাকদ্বীপ যাওয়ার বাস পেতে পারেন। সময় লাগবে প্রায় ৩ ঘন্টা। সেখান থেকে মুড়িগঙ্গা নদী নৌকা বা লঞ্চে পেরিয়ে পৌঁছবেন কচুবেড়িয়াকচুবেড়িযা থেকে গঙ্গাসাগরে যাওয়ার বাস বা গাড়ি পাওয়া যায়। সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা

ট্রেনে :

আপনি শিয়ালদহ থেকে রেলপথেও যাত্রা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে শিয়ালদহ থেকে কাকদ্বীপ বা নামখানা পৌঁছতে হবে। তবে এই রেলপথ, দেশের বাকি অংশের থেকে বিচ্ছিন্ন। আপনি যে স্টেশন থেকেই যাত্রা শুরু করুন না কেন, সাগরদ্বীপ পৌঁছতে ট্যাক্সি, বাস ও নৌ-পথে যেতেই হবে

বায়ুপথ :

কলকাতার দম দমে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করুন। এর পরে, সড়কপথের জন্য একই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হল গঙ্গাসাগরে পৌঁছানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার হেলিকপ্টার পরিষেবাগুলি পরিচালনা করে।

গঙ্গাসাগর মেলার সময় কোথায় থাকবেন

অনুষ্ঠানস্থলে রাজ্য সরকার কর্তৃক বিভিন্ন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। দর্শনার্থীরা সেখানে থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন। আপনার পায়ের বিশ্রামের জন্য কাছাকাছি কটেজ এবং হোটেল রুম রয়েছে

কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান

রাত্রিবেলা মেলা প্রাঙ্গন

গঙ্গাসাগর মেলায় আসা তীর্থযাত্রীরা প্রায়শই সাগরদ্বীপের কপিল মুনি মন্দিরে যাওয়ার প্রথা হিসাবে তাদের নতুন ভোরে শুরু করেন। এখানে প্রার্থনা ও পূজা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পরিচালিত হয়।

একটু আগে বুকিং যদিও আবশ্যক তবে এই স্থানগুলি ছাড়াও, আপনি মেলার মাঠ, সমুদ্র সৈকত, সাগর মেরিন পার্ক, সাগর বাতিঘর এবং বন্দর, রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, সুষমাদেবীচৌধুরানী মেরিন বায়োলজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসডিএমবিআরআই), চিমাগুড়ি মুডফ্লাট দেখতে পারেন। এক বা দুই দিনের জন্য আপনার ছুটি বাড়াতে পারেন তবে আপনি এই জায়গার প্রাণবন্ত উচ্ছলতা অনুভব করতে পারবেন । কলকাতার কাছাকাছি দেখার জন্য অনেকগুলি ভাল জায়গা যেমন মৌসুনি দ্বীপ, বকখালি ইত্যাদি রয়েছে, আপনি সময় এবং আগ্রহের উপর নির্ভর করে আপনার ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে পারেন।

সব শেষে বলা যায়

গঙ্গাসাগর, বলা যায়, বাংলার প্রাচীনতম ও বৃহত্তম এক মহাতীর্থ যার উল্লেখ ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতে পাওয়া যায়। প্রাচীন লোককথা অনুযায়ী, গঙ্গাসাগরে কপিল মুনির মন্দির প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন রানী সত্যভামা এবং ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরের বর্তমান আরাধ্য মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন স্বামী রামানন্দ। এ এক মহান ঐতিহ্য, যার আলোতে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগমে আজও জ্বল জ্বল করছে। আপনি গঙ্গাসাগর মেলায় প্রজ্বলিত প্রদীপ এবং জপ মন্ত্রের দৃশ্য কখনও ভুলতে পারবেন না। মনে হবে আপনার আত্মা মোক্ষ লাভ করেছে এবং আপনি পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন।

ঠিক এই একই দিনে আরও একটি লোক উৎসব জয়দেব কেন্দুলীর মেলা বীরভূম জেলাতে হয় এখানেই পড়ে দেখুন ভাল লাগবে।

Picture credit: pipanews.com

Leave a Comment