জয়দেব কেঁদুলি মেলা পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশের সবথেকে জনপ্রিয় গ্রামীণ মেলা। বীরভূম জেলার কেঁদুলি বা কেন্দুবিল্ব গ্রাম কবি জয়দেবের জন্মভূমি। অজয় নদের তীরে এই কেন্দুলি গ্রামে বাউল আখড়ায় বসে জমজমাট গানের আসর। কথিত আছে কবি জয়দেব গোস্বামী প্রতি বছর মকর সংক্রান্তিতে স্নান করতে যেতেন কাটোয়ার গঙ্গায়। এক বার তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ওই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। সেই রাত্রে তিনি স্বপ্ন দেখেন তাঁর জন্য মা গঙ্গা উজানে এসে অজয় নদে মিলিত হলেন। তাই অজয় নদে স্নান করলেই তিনি গঙ্গাস্নানের ফল পাবেন। কবি জয়দেবের সের পুন্যস্নান উপলক্ষে মকর সংক্রান্তিতে ইলামবাজারের কেঁদুলিতে অজয় নদের তীরে আয়োজন করা হয় জয়দেব কেঁদুলি মেলা।
জয়দেব কেঁদুলি মেলার ইতিহাস
জয়দেব কেঁদুলি মেলা বহু প্রাচীন। যেমন ১৮৮২ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে ‘অজয়তীরে কেন্দুবিল্বে জয়দেব গোস্বামী’র মেলার উল্লেখ আছে। কবি জয়দেব গোস্বামীর “গীতগোবিন্দ” কাব্য রচনার সময়কাল হল ১১৫৯ সালে এবং সেই সময়েই এক পৌষ-সংক্রান্তির দিন কবি জয়দেব মা গঙ্গার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন বলে কথিত। ঐতিহাসিকদের মতে মা গঙ্গাকে স্মরণ করে অজয় নদে মকরস্নান উপলক্ষে এই মেলার সূচনা হয়েছিল। পরে তার সঙ্গে জয়দেবীয় ঐতিহ্য যুক্ত হয়ে তা হয়েছে জয়দেবের মেলা। জয়দেব রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি ছিলেন।
অনেকেই জয়দেব এবং কেঁদুলি মেলাকে একটি মেলা মনে করেন । আসলে কেন্দুলি মেলা আয়োজন করা হয় পশ্চিম বর্ধমান জেলার কাঁকসায়। জয়দেব মেলা আয়োজিত হয় অজয় নদীর পাড়ে। আবার কেন্দুলি মেলা আয়োজিত হয় দামোদরের পাড়ে। জয়দেবের অন্যতম শিষ্য বাউল দাসের স্মৃতির উদ্দেশে শুরু হয়েছিল এই মেলা। তারপর থেকে চিরাচরিত ভাবে চলছে কেঁদুলি মেলা । অনেকেই বলেন জয়দেব মেলা ও কেন্দুলি মেলা একে অপরের পরিপূরক। ৩০০ বছর ধরে কাঁকসার সিলামপুরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বাউল দাসের কেন্দুলি মেলা। জানা গিয়েছে, কবি জয়দেবের শিষ্য ছিলেন বাউল দাস। গত কয়েকশো বছর আগে তিনি কাঁকসার সিলামপুরে নিজের আখড়া তৈরি করেন। সেখানেই বসবাস করতেন বাউল দাস। পরে তিনি মারা গেলে, সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
জয়দেব কেন্দুলি মেলার প্রধান আকর্ষনগুলি কি কি
মকরের পূণ্যস্নান
কবি জয়দেবের মকর বাহিনী মা গঙ্গার অজয় নদে দর্শন লাভ স্মরণে মকর সংক্রান্তিতে পুণ্যার্থীরা অজয় নদে স্নান করেন। এই পুন্য স্নানে শ্রদ্ধালু জনগনের রোগমুক্তি হয়, এই বিশ্বাসে অজয় নদে স্নান করেন। সেখানে ডুব দেওয়ার জন্য পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা ঘাট বানানো হয়।
বাউল এবং কীর্তন
কেন্দুলির মেলা মানেই বাউল গানের আসর সঙ্গে কীর্তনের আখড়া। এই বাউল গানের এবং কীর্তনের আসন ছাড়া এই মেলা অসম্পুর্ন। প্রতিবছর এই মেলায় কীর্তনীয়াদের এবং বাউলদের জন্য আলাদা আলাদা কয়েকশ আখড়া তৈরি হয়। তাই এই মেলা আজ বিশ্বে বাউল মেলা হিসেবে বেশি পরিচিত।
সাহিত্য চর্চা
এই মেলার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সাহিত্যের আসর। বর্তমান কালে সত্যই দুর্লভ, এই মেলায় সারা রাত ধরে চলে সাহিত্য আলোচনা এবং কবিতা পাঠ। মেলা উপলক্ষে অসংখ্য পত্রপত্রিকাও প্রকাশিত হয়।
অন্নসত্ৰ
এই জয়দেব কেঁদুলি মেলার আর এক বিশেষত্ব হচ্ছে এখানকার অন্নসত্রগুলি। মন্দির চত্বর ছাড়িয়ে স্নানঘাটের রাস্তার দু-ধার বরাবর শ্রদ্ধালু নিরন্ন অসহায় মানুষের স্রোত এসে মিশে যায় অজয়ের বালুচরে।
বেচাকেনা
প্রচুর হস্তশিল্প সামগ্রি, পাথরের বাসন, লোহার জিনিষপত্র এই মেলায় কেনাবেচা হয়। এছাড়া নাগরদোলা, সার্কাস, পুতুলনাচ তো রয়েছেই। সরকারি ভাবে মেলা ৪ দিনের হলেও মেলা চলে প্রায় ১৫ দিন। কাছাকাছি জেলাগুলির অর্থনিতিতে এই মেলার প্রভাব অনেক।
কিভাবে যাবেন জয়দেব কেঁদুলি মেলায়
কোলকাতা থেকে কেঁদুলি যাবার দুটি পথ আছে – একটি বোলপুর হয়ে এবং অপরটি দুর্গাপুর হয়ে তারপর বাসে বা গাড়িতে কেন্দুলি। দুর্গাপুর বা বোলপুর থেকে কেন্দুলির দুরত্ব প্রায় সমান, ওই ২৫ থেকে ৩০ কিমির মত। দুর্গাপুর স্টেশন থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস আছে।
ট্রেনে গেলে হাওড়া থেকে সকাল বেলা “হুল” এক্সপ্রেস বা ইস্পাত ধরা যেতে পারে।
গাড়িতে গেলে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস হয়ে খুব সহজেই আসা যেতে পারে।
জয়দেব কেঁদুলি মেলায় কোথায় থাকবেন
জয়দেব কেঁদুলি মেলা যদিও রাজ্য ছাড়িয়ে সারা দেশে বেশ জনপ্রিয় এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছেলও এটি মূলত গ্রামীণ মেলা। কোনও হোটেল, লজ বা অতিথিশালা পাওয়া যায়না। ভরসা কেবল গৃহস্থদের ঘরভাড়া নেওয়া ও বাউলদের আখড়া।
আশেপাশে ঘোরার জায়গা
দূর থেকে যাঁরা এই সময় জয়দেবে মেলা দেখতে যান, তাঁরা চাইলে আশেপাশের আরও কয়েকটি পর্যটনস্থলও ঘুরে দেখতে পারেন।
কেন্দুলি মেলা যেখানে বসে তার কাছেই অজয় নদের পাড়ে পশ্চিম বর্ধমান জেলায় অবস্থিত গড় জঙ্গল। কেন্দুলি মেলা দেখে ফেরার পথে এই জায়গাটি দেখে নিতে পারেন। এই জঙ্গলে মা শ্যামরূপার মন্দির আছে। এছাড়াও রয়েছে একটি আশ্রম। শোনা যায় এই আশ্রমেই প্রথম দুর্গাপুজো করেছিলেন রাজা সুরথ। পাশাপাশি রয়েছে ইছাই ঘোষের মন্দির। তাছাড়াও রয়েছে দেউল পার্ক। সব মিলিয়ে মেলার পাশাপাশি গড় জঙ্গল ঘুরে দেখতে বেশ লাগবে।
আপনি চাইলে এই বীরভূম জেলাতেই শান্তিনিকেতন ঘুরে আসতে পারেন এবং একটা সুন্দর শান্ত ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে দু-একটা দিন কাটিয়ে আসতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে।
কিছু অতিরিক্ত তথ্য নিচে দেওয়া হল
জয়দেবের মেলা কোথায় হয়?
বীরভূম জেলায় অজয় নদের তীরে কেন্দুলিতে হয়।
জয়দেবের মেলা কখন হয়?
প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির দিন জয়দেবের মেলা শুরু হয়।
জয়দেব কার সভাকবি ছিল?
জয়দেব ছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি।
জয়দেবের কাব্যের নাম কি?
তিনি গীতগোবিন্দ কাব্য রচনা করেন।
জয়দেবের পিতা ও মাতার নাম কী?
জয়দেবের পিতা ছিলেন ভোজদেব ও মাতার নাম বামাদেবী।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷