ভারতের জনপ্রিয় উৎসব : বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির 14 টির বর্ণনা

ভারতের জনপ্রিয় উৎসব

ভারতের জনপ্রিয় উৎসব, আসলে ভারতবর্ষের দৈনন্দিন জীবনে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা এমনভাবে মিশে আছে, যেন জীবন আর উৎসব একে অপরের পরিপূরক। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন—বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করেন এবং নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী বিভিন্ন উৎসব পালন করেন। ফলে প্রায় প্রতিটি মাসেই দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে চলে উৎসবের আনন্দ।

এই উৎসবগুলোর বেশিরভাগই চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী পালিত হয়, তাই প্রতিবছর তারিখ কিছুটা পরিবর্তিত হয়। সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়টা ভারতের উৎসব-ঋতু হিসেবে পরিচিত। যদি আপনি ভারত ভ্রমণের পরিকল্পনা করে থাকেন, তাহলে এই সময়ে আসার চেষ্টা করুন—এই সময় দেশজুড়ে রঙ, রীতি ও রসনার এক মহোৎসব চলতে থাকে।

চলুন জেনে নেওয়া যাক ভারতের 14 টি উল্লেখযোগ্য উৎসব সম্পর্কে, যেগুলো আপনাকে ভারতীয় সংস্কৃতির হৃদয়ে পৌঁছে দেবে।

Table of Contents

১. পোঙ্গল – তামিলনাড়ুর ফসল উৎসব

কখন: জানুয়ারির মাঝামাঝি
কোথায়: তামিলনাড়ু

চার দিনব্যাপী এই উৎসবে ধান কাটা থেকে শুরু করে সূর্যদেবের পূজা পর্যন্ত নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। প্রথম দিন ‘ভোগি’ তে বাড়ি পরিষ্কার করা হয় এবং রঙিন রঙ্গোলি আঁকা হয়। দ্বিতীয় দিন সূর্য পোঙ্গল—এই দিনে নবচাল, দুধ ও গুড় দিয়ে পোঙ্গল রান্না করে সূর্যদেবতাকে উৎসর্গ করা হয়। পরের দিন মাট্টু পোঙ্গল গবাদিপশুর সম্মানে পালন করা হয়, আর শেষ দিন ‘কানুম পোঙ্গল’-এ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে মিলনমেলা হয়।

২. মহাশিবরাত্রি – শিবভক্তদের রাত্রি জাগরণ

কখন: ফাল্গুন মাসের অমাবস্যা
কোথায়: মান্ডি, ঋষিকেশ, গুয়াহাটি

এই পবিত্র রাতে ভক্তরা উপবাস করে শিবমন্দিরে যান এবং শিবলিঙ্গে দুধ, দই ও মধু নিবেদন করেন। সারা রাত ধরে চলে ভজন ও পূজা। হিমাচলের মান্ডিতে ভূতনাথ মন্দিরে এই উৎসব উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে। এছাড়া উত্তরাখণ্ডের ঋষিকেশ ও অসমের গুয়াহাটিতেও মহাশিবরাত্রির বিশেষ আয়োজন থাকে।

আরও পড়ুন: ভারতের সেরা 10 টি অ্যাডভেঞ্চার স্পট লাদাখ থেকে আন্দামান

৩. হোলি – রঙের উৎসবে মাতোয়ারা দেশ

কখন: ফাল্গুনী পূর্ণিমা
কোথায়: উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লি

হোলি মানেই রঙ, মজা আর বন্ধুত্বের উল্লাস। কৃষ্ণ ও রাধার প্রেমের প্রতীক এই উৎসবে সবাই গুলাল বা আবির ছিটিয়ে, পিচকারি দিয়ে জল ও রঙ ছিটিয়ে একে অপরকে রঙে রাঙিয়ে দেয়। হোলি ভারতের জনপ্রিয় উৎসব সমূহের অন্যতম । এর সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর রূপ দেখতে হলে চলে যান মথুরা ও বৃন্দাবনে—যেখানে কৃষ্ণ তাঁর শৈশব কাটিয়েছিলেন।

৪. ঈদ-উল-ফিতর – ত্যাগের শেষে আনন্দ

কখন: রমজান মাস শেষে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে
কোথায়: সারা ভারত

এক মাস উপবাসের পর ঈদের দিন শুরু হয় প্রার্থনা ও উৎসবের মাধ্যমে। সকালে ঈদের নামাজ পড়া হয় এবং দরিদ্রদের জন্য ‘জাকাত-আল-ফিতর’ প্রদান করা হয়। খাওয়া-দাওয়ার অংশে থাকে সুস্বাদু ‘শির খুরমা’ ও ‘সেভাইয়া’, যেগুলো দুধ, সেমাই ও শুকনো ফল দিয়ে তৈরি।

আরও পড়ুন: উত্তর প্রদেশের দর্শনীয় 12 টি মন্দির সম্পর্কে জানুন

৫. বিহু – অসমের প্রাণের উৎসব

কখন: এপ্রিলের মাঝামাঝি
কোথায়: অসম

রঙালী বিহু হল অসমের নববর্ষ ও ফসল তোলার উৎসব। সাত দিন ধরে চলে এই বিহু উৎসব, যেখানে মানুষ পরিধান করেন তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, নাচ-গানের মাধ্যমে আনন্দ করেন। বিহু নাচ, লোকগান আর ভোজনেই মেতে ওঠে সবাই। খাওয়াদাওয়ায় থাকে মাছের টক, নানা রকম পিঠা ও ‘আপং’ নামে চালের তৈরি দেশি মদ।

৬. ওনম, কেরালা

কখন: দশদিনব্যাপী
কোথায়: কেরালা

কেরালার সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসব ওনম ধর্ম বা জাতিগত সীমারেখা ছাড়াই সবার মধ্যে উদযাপিত হয়। এই দশদিনের ফসল তোলার উৎসবটি প্রাচীন রাজা মহাবলিকে উৎসর্গ করা হয়েছে, যিনি ওনমের দিনে তাঁর প্রভুকে পরিদর্শন করার জন্য অভিহিত হন। ঐ সময়ে ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত, ভাস্কর্যবাজা সাঁকো ও অলংকৃত হাতিরা নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আথাচামায়াম নামের দুর্দান্ত পথযাত্রা । কেরালার নদী ও হ্রদে স্নেক-বোট রেসও বেশ জনপ্রিয়। ঐতিহ্যবাহী কলা-কলায় রচিত অবিশ্বাস্য ভোজ ‘ওনসাদ্যা‘—যেখানে কলা পাতায় সাজানো নানা শাকাহারী পদ—অবশ্যই ট্রাই করতে ভুলবেন না।

পড়ে দেখতে পারেন: পশ্চিমবঙ্গে সেরা 5টি ট্রেকিং রুট – পাহাড় ও রিভার ক্যানিয়ন ট্রেক

৭. জন্মাষ্টমী, মুম্বাই ও পুনে

কখন: জন্মের রাতের অর্ধরাত্রি
কোথায়: মুম্বাই ও পুনে

জন্মাষ্টমী (অথবা গোকুলাষ্টমী) উৎসবটি জন্মাষ্টমী নামে পালন করা হয়, যা প্রভু কৃষ্ণের জন্মদিবস। বলা হয়, কৃষ্ণ অর্ধরাত্রিতে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, এজন্য ভক্তরা রাত ভর জাগরণ করেন, প্রার্থনা পাঠ করেন এবং ভজন (ধর্মীয় গান) গান। কৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরায় তাঁর জীবনের নাটকীয় দৃশ্যপট ‘রাস লীলার‘ মাধ্যমে প্রাণ পেলেও, মুম্বাই ও পুনে শহরগুলোতে ঐ রসালো উল্লাসের সেরাটি উপভোগ করতে পারবেন। পরবর্তী দিনে ‘দহি হান্ডি‘ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উচ্চ মানব পিরামিড গঠন করে একটি দইয়ের হাঁড়ি ভাঙার চেষ্টা করা হয়—যা কৃষ্ণের প্রিয় খাদ্য হিসেবে বিবেচিত।

৮. গণেশ চতুর্থী, মহারাষ্ট্র

কখন: দশদিনব্যাপী
কোথায়: মহারাষ্ট্র, বিশেষ করে মুম্বাই

গণপতি বাপ্পার প্রতি ভক্তি নিবেদন করে দশদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় গণেশ চতুর্থী উৎসব। মুম্বাই শহরে আয়োজন করা ব্যাপক প্যান্ডাল (মণ্ডপ) ও সুন্দরভাবে সাজানো মূর্তির জন্য এটি সবার মধ্যে জনপ্রিয়। “লালবাগচা রাজা“, “জিএসবি সেবা মণ্ডল গণপতি” ও “অন্ধেরিচা রাজা”—এসব উদাহরণ অন্যতম। দশম দিনে বৃহৎ পর্বের মধ্যে মূর্তি विसর্জনের জন্য সমুদ্রের তীরে বৃহৎ প্রসাদ নিয়ে চলা হয়, সাথে বাজনা, জোরালো সঙ্গীত ও রাস্তায় নাচগানের মজা, সে এক এলাহি আয়োজন থাকে।

পড়ে দেখুন: উত্তর-পূর্ব ভারত গরমে বেড়াতে যাওয়ার জায়গা সেরা 6 টি গন্তব্য

৯. নবরাত্রি ও দশহরা, উত্তর ও পশ্চিম ভারত

কখন: নবরাত্রি (নয় দিনের উৎসব) ও দশহরা (দশম দিন)
কোথায়: উত্তর ও পশ্চিম ভারত, বিশেষ করে গুজরাট

ভারতের নবরাত্রি উৎসবটি দেবী দুর্গাকে উৎসর্গ করে নয় দিন ধরে পালন করা হয়, প্রতিটি দিন ভিন্ন ভিন্ন আচার-পদ্ধতিতে। গুজরাটে রঙিন ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত নৃত্যপর্ব ‘গরবা‘ ও ‘ডান্ডিয়া‘ নয় রাত জুড়ে উদযাপিত হয়। অনেক অঞ্চলে রামায়ণের নাট্য রূপকার্যও অনুষ্ঠিত হয়। দশম দিন দশহরা ঈশ্বর রাম যখন দশমুলীয় রাক্ষস রাবণের উপর বিজয় লাভ করেন, সেই ইতিহাস উদযাপন করে; ভক্তরা রাবণের বৃহৎ মূর্তি পুড়িয়ে মন্দের উপর ভালোর জয় উদযাপন করেন।

১০. দুর্গা পূজা, পশ্চিমবঙ্গ

কখন: নির্ধারিত সময় অনুযায়ী, সাধারনত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর
কোথায়: পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতা

যদিও দেশজুড়ে বিভিন্ন রূপে পালন করা হলেও, দুর্গা পূজার মহিমা সর্বাধিক প্রকাশ পায় পশ্চিমবঙ্গের ময়দানে। কলকাতা শহরটি বিশাল থিমযুক্ত প্যান্ডাল দিয়ে ভরা থাকে যেখানে দেবী দুর্গার বড় বড় মূর্তি সাজানো থাকে। ‘দেশপ্রিয় পার্ক’, ‘ বালীগঞ্জ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘কুমারটুলি পার্ক’ সহ কয়েক শত প্যান্ডালের যেকোন প্যান্ডালে ঢুকে যান, আর পাশের রাস্তার মুখরোচক খাবারও উপভোগ করুন। ধর্মীয় আচার ছাড়াও, অনেক প্যান্ডালে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম যেমন সঙ্গীত, নৃত্য ও নাটকের আয়োজন করা হয়। কলকাতার বাজারগুলোও নতুন পোশাক, হস্তশিল্প ও মিষ্টান্ন কেনাকাটায় ভিড় থাকে।

১১. দীপাবলি, সারা ভারত

কখন: নির্ধারিত সময় অনুযায়ী, সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর
কোথায়: সারা ভারত

দীপাবলি সম্ভবত ভারতের জনপ্রিয় উৎসব, দেশের সবচেয়ে বৃহৎ উৎসব, যা শ্রীরাম চন্দ্রের ১৪ বছরের বনবাসের পর গৃহে প্রত্যাবর্তনের স্মরণে পালিত হয়। পাঁচদিনব্যাপী এই উৎসবে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী যেমন—কৃষ্ণের দ্বারা রাক্ষস নরকাসুরের দমন বা দেবী লক্ষ্মীর জন্ম উদযাপন করা হয়। নতুন জামাকাপড় পরিধান, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে মিলিত হওয়া, রং-বেরঙের আতশবাজি, লণ্ঠন ও প্রদীপ (মাটির বাতি) জ্বালিয়ে দীপাবলি উদযাপন করা হয়। প্রতিটি অঞ্চলের স্বাদের কিছু পার্থক্য থাকলেও, দীপাবলির সময় নানা রকম মিষ্টান্ন ও নোনা খাবারের ভোজ ছাড়া উৎসব অসম্পূর্ণ।

১২. গুরু নানক জয়ন্তী, পাঞ্জাব

কখন: নির্ধারিত সময় অনুযায়ী
কোথায়: পাঞ্জাব

গুরু নানক জয়ন্তী বা গুরু নানক গুরপরব প্রথম শিখ গুরু’র জন্মদিবস হিসেবে পালিত হয় এবং শিখ ধর্মের অন্যতম প্রধান উৎসব। গুরু নানক জয়ন্তীতে পাঞ্জাবের গুরদ্বারাগুলো রঙিন সাজসজ্জায় পূর্ণ থাকে এবং অনেক গুরদ্বারে ‘অখণ্ড পাঠ’ অনুষ্ঠিত হয়। ভক্তরা পাল্কিতে গুরুর পবিত্র গ্রন্থ বহন করে, আর ভজন গাইতে গাইতে নগর পরিভ্রমন করেন। নবীন শিখরা ‘গটকা‘—লাঠি যুদ্ধের একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা—ও প্রদর্শন করে।

১৩. ক্রিসমাস, সারা ভারত

কখন: ২৫ ডিসেম্বর
কোথায়: সারা ভারত, বিশেষ করে গোয়া, মুম্বাই ও কলকাতা

ক্রিসমাস ভারতবর্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে পালিত হয়, যা কেবল খ্রিস্টানদের নয় বরং সকল ধর্মের মানুষ উদযাপন করে। গোয়া শহর এই উল্লাস উদযাপনের জন্য অন্যতম শীর্ষস্থানীয়; সেখানে বিশাল ন্যাটিভিটি সিন, মধ্যরাত্রির মাস, ক্যারল সঙ্গীত, ক্রিসমাস গাছ এবং প্রচুর স্থানীয় মিষ্টান্ন—যেমন, ডোডল (চিড়া-পাঁঠালসহ মিষ্টি পুডিং) ও নয়ুরোস (নারিকেলের পুরানো পেস্ট্রি)—দেখার কেবলই নয়, স্বাদ গ্রহণেরও সুযোগ থাকে। মুম্বাই ও কলকাতাতেও চারু আলো ঝলমলে চারপাশে, যেখানে চার্চগুলো আলোকসজ্জিত, এবং হোটেল ও শপিং মলগুলো ক্রিসমাসের সজ্জায় মোড়ানো থাকে।

১৪. কুম্ভ মেলা

কখন: ১২ বছরে ৪বার, কয়েক সপ্তাহ ধরে
কোথায়: চারটি পবিত্র তীর্থস্থান
    – হরিদ্বার (গঙ্গা)
    – উজ্জয়িন (শিপ্রা)
    – নাসিক (গোদাবরী)
    – প্রয়াগরাজ (গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর মিলনস্থলে)

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ হিসেবে পরিচিত কুম্ভ মেলা প্রতি ১২ বছরে চারবার অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা চলাকালীন লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী ও সাধু নদীতে পবিত্র স্নান করার জন্য একত্রিত হন। প্রতিটি মেলার সময়কাল কয়েক সপ্তাহ ধরে চলে, যা ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক অপরূপ উদাহরণ।

উপসংহার

ভারতের প্রতিটি উৎসব তার নিজস্ব ইতিহাস, রীতি ও স্বাদের বাহক। উৎসব মানেই এখানে শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি মানুষে-মানুষে মিলনের সেতু। আপনি যদি সংস্কৃতিপ্রেমী ভ্রমণকারী হয়ে থাকেন, তাহলে এসব উৎসবের সময় এই দেশের রঙিন প্রাণবন্ততা আপনাকে মুগ্ধ করবেই।

📌 পরামর্শ: উৎসবের নির্দিষ্ট তারিখ জানতে ভ্রমণের আগে স্থানীয় পর্যটন দপ্তর বা সরকারিভাবে প্রকাশিত ক্যালেন্ডার অবশ্যই দেখে নিন।

Leave a Comment