কলকাতার গির্জা ভ্রমণ বিশেষ করে বড়দিনের সময়ে, বিশেষ করে কলকাতাবাসীর অনেকেরই গন্তব্যে পরিণত হয় সেন্ট পলস গির্জা । কিন্তু এর বাইরেও কলকাতায় রয়েছে আরও বহু প্রাচীন গির্জা। এই সমস্ত গির্জা ঘুরে দেখার মাধ্যমে শহরের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শনগুলো দেখা যায়। কলকাতার উল্লেখযোগ্য কিছু গির্জার অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী এবং ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হওয়া একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হতে পারে।
কলকাতার গির্জা : জনপ্রিয় 9 টি – Churches in Kolkata
আমরা এখানে কলকাতার উল্লেখযোগ্য 9 টি গির্জার একটি তালিকা তুলে ধরলাম । তাহলে দেখে নেওয়া যাক এখান থেকে।
১. সেন্ট পল’স ক্যাথেড্রাল
সেন্ট পল’স ক্যাথেড্রাল সম্ভবত কলকাতার সবচেয়ে আইকনিক গির্জা। এটি ইন্দো-গথিক স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। ১৮৪৭ সালে নির্মিত এই ক্যাথেড্রাল এশিয়ার প্রথম এপিস্কোপাল গির্জা হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি ২৪৭ ফুট লম্বা, ৮১ ফুট চওড়া এবং ট্রান্সেপ্টে ১১৪ ফুট উচ্চ। ক্যাথেড্রালটির ২০১ ফুট উচ্চ টাওয়ার এবং ১৭৫ ফুট উচ্চ ফ্ল্যাগস্টাফ একে আরও দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে।
মূল হলটি সযত্নে খোদাই করা কাঠের পিউ এবং চেয়ারে সজ্জিত। অভ্যন্তরে জটিল ডিজাইনের স্টেইনড গ্লাস, দেয়ালে ফুলেল নকশা এবং ফ্লোরেন্টাইন রেনেসাঁ স্টাইলে তৈরি দুটি ফ্রেসকো চার্চটির শোভা বৃদ্ধি করে।
সেরা সময়: বড়দিনের আগের সন্ধ্যায়, যখন এটি উৎসবের সাজে সজ্জিত থাকে।
- অবস্থান: ক্যাথেড্রাল রোড, কলকাতা
- ধর্মীয় সম্প্রদায়: চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়া (প্রোটেস্ট্যান্ট)
- সময়: সোমবার থেকে শনিবার: সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা।
রবিবার: সকাল ৭:৩০ থেকে সন্ধ্যা ৬টা। - কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ময়দান, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম
২. সেন্ট থমাস গির্জা
সেন্ট থমাস গির্জা কলকাতার অন্যতম সুন্দর গির্জা। এটি ক্লাসিকাল উপনিবেশীয় স্থাপত্যশৈলীর দৃষ্টান্ত। বিশাল টাওয়ারটি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গির্জার অভ্যন্তরে রয়েছে উঁচু সিলিং, বড় জানালা এবং দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্ম।
১৯৯৭ সালে মাদার তেরেসার দেহ তাঁর অন্ত্যেষ্টির আগে এক সপ্তাহ ধরে এই সেন্ট থমাস গির্জায় রাখা হয়েছিল, যা এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে।
- অবস্থান: স্যার উইলিয়াম জোনস সরণি, পার্ক স্ট্রিট এলাকা, কলকাতা
- ধর্মীয় সম্প্রদায়: রোমান ক্যাথলিক
- সময়: প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা
- কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান: আলিপুর চিড়িয়াখানা, বিদ্যাসাগর সেতু, জেমস প্রিন্সেপ স্মৃতিসৌধ
আরও পড়ুন: কলকাতার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় 10টি মন্দির
৩. সেন্ট জন’স চার্চ
একসময় কলকাতার অ্যাংলিকান ক্যাথেড্রাল হিসেবে পরিচিত সেন্ট জন’স চার্চ ১৭৮৭ সালে নির্মিত হয়। এটি কলকাতার তৃতীয় প্রাচীনতম গির্জা এবং এটি এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে পরিচিত। সেন্ট জন’স চার্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা নির্মিত প্রথম কয়েকটি পাবলিক বিল্ডিংয়ের মধ্যে একটি, যা কলকাতাকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী করার পরে তৈরি হয়েছিল। পাথর ও ইট দিয়ে নির্মিত হওয়ায় এটি স্থানীয়দের কাছে “পাথুরে গির্জা” নামে পরিচিত।
চার্চটি নব্য-ধ্রুপদী স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি একটি বর্গাকার কাঠামো। এর অন্যতম আকর্ষণ হলো ১৭৪ ফুট উঁচু পাথরের সুউচ্চ মিনার, যার উপর রয়েছে দৈত্যাকৃতির একটি ঘড়ি যা প্রতিদিন ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও বিখ্যাত ব্রিটিশ শিল্পী জোহান জফানির আঁকা “লাস্ট সাপার” চিত্রকর্মটি চার্চের বেদির বাঁ পাশে দেখা যায়। চার্চটি এমন এক জমিতে দাঁড়িয়ে আছে যা একসময় কবরস্থান ছিল। এখনও এখানে বেশ কয়েকটি কবর রয়েছে, যার মধ্যে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নকের কবর অন্যতম। এছাড়াও, ব্ল্যাক হোল মনুমেন্ট এবং সেকেন্ড রোহিলা ওয়ার মেমোরিয়াল গির্জা কমপ্লেক্সের অন্য প্রধান আকর্ষণ।
- অবস্থান: কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট, ডালহৌসি স্কোয়ার
- ধর্মীয় সম্প্রদায়: চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়া (প্রোটেস্ট্যান্ট)
- সময়: প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা
- কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান: রাইটার্স বিল্ডিং, ইডেন গার্ডেন, মিলেনিয়াম পার্ক
৪. চার্চ অব ক্রাইস্ট দ্য কিং
কলকাতার পার্ক সার্কাস অঞ্চলে অবস্থিত গির্জা অব ক্রাইস্ট দ্য কিং স্থাপত্য সৌন্দর্যের জন্য খ্যাত। চার্চের বাইরে যেমন দৃষ্টিনন্দন, ভেতরের পরিবেশও তেমনই প্রশান্তিময়। বিশাল এই চার্চটিতে শতাধিক মানুষ একসঙ্গে বসতে পারেন।
বড়দিনের সময় এলে, এই চার্চে মধ্যরাতের প্রার্থনায় যোগ দেওয়ার চেষ্টা করুন। সুন্দরভাবে সজ্জিত এই গির্জা এবং প্রার্থনার পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে।
- অবস্থান: সৈয়দ আমির আলি এভিনিউ, পার্ক সার্কাস,
- ধর্মীয় সম্প্রদায়: রোমান ক্যাথলিক
- সময়: প্রতিদিন সকাল ৬:১৫ থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০
- কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ময়দান, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম
আরও পড়ুন: কলকাতার সেরা ব্রেকফাস্টের 11টি বাছাই করা জায়গা
৫. আর্মেনিয়ান চার্চ অব দ্য হোলি নাজারেথ
১৭২৪ সালে নির্মিত আর্মেনিয়ান চার্চ অব দ্য হোলি নাজারেথ কলকাতার অন্যতম প্রাচীন গির্জা । যদিও এর নকশায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে, এটি শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত। এর বর্তমান নকশা আঘা জাকোব নাজার দ্বারা তৈরি, আগের চার্চটি ১৬৮৮ সালে আগুনে ধ্বংস হয়েছিল।
ভারতের অবস্থিত সমস্ত আর্মেনিয়ান অ্যাপোস্টোলিক চার্চের মধ্যে কলকাতার চার্চটি প্রাচীনতম। সাদা রঙের এই চার্চটি চারপাশে সবুজ গাছপালা দিয়ে ঘেরা। চার্চের দেয়ালে মনোমুগ্ধকর চিত্রকর্ম এবং ফ্রেসকোগুলো দর্শকদের মুগ্ধ করে।
- অবস্থান: আর্মেনিয়ান স্ট্রিট, কলকাতা
- ধর্মীয় সম্প্রদায়: আর্মেনিয়ান অ্যাপস্টলিক চার্চ (ওরিয়েন্টাল অর্থডক্স)
- সময়: প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা
- কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান: রাইটার্স বিল্ডিং, রাজভবন, প্রিন্সেপ ঘাট
৬. সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ
কলকাতার স্কটিশ গির্জাগুলির অন্যতম ডালহৌসি অঞ্চলে স্থাপিত সেন্ট অ্যান্ড্রুজ গির্জা। এটি গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। এখানেই আগে ছিল পুরনো মেয়র্স কোর্ট। এখানে এক বিচারসভায় মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। ১৭৯২ সালে পুরনো আদালতের বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। তবে পুরনো আদালতের কথা মনে রেখে রাস্তাটির নামকরণ করা হয় ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট।
সরলতায় সৌন্দর্যের নিদর্শন হিসেবে এটি পরিচিত। এর উঁচু সুউচ্চ মিনার দূর থেকে মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং কলকাতার অন্যতম চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত। এই চার্চের স্নিগ্ধ সাদা কাঠামো এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়।
- অবস্থান: বিবিডি বাগ নর্থ, বড়বাজার
- ধর্মীয় সম্প্রদায়: চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়া (প্রোটেস্ট্যান্ট)
- সময়: প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা
- কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান: রাইটার্স বিল্ডিং, রাজভবন, মিলেনিয়াম পার্ক
৭. গ্রীক অর্থডক্স চার্চ
যদিও গ্রিকরা বহু আগেই কলকাতা ছেড়েছে, তাদের কিছু স্থাপনা এখনও শহরে বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম হলো গ্রীক অর্থডক্স চার্চ, যা কালিঘাট ট্রাম ডিপোর ঠিক পাশে অবস্থিত। এখানে প্রার্থনার সময় কইনে গ্রিক ভাষায় পড়া এবং আচার-অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়, যা ঐতিহ্যবাহী গ্রিক উপভাষা।
গ্রিকরা ১৮ শতকে কলকাতায় তাদের প্রথম উপাসনালয় তৈরি করলেও, গ্রীক অর্থডক্স চার্চটি ১৯২৫ সালে নির্মিত হয়। এর গ্র্যান্ড কাঠামোটি চারটি ডোরিক স্তম্ভ সহ একটি প্রাচীন মন্দিরের মতো দেখায়। এর অভ্যন্তরে বিশাল ঝাড়বাতি এবং কাঠের পিউস রয়েছে। বেদিটি পালিশ করা কাঠ দিয়ে তৈরি এবং এর গায়ে চিত্রাঙ্কিত প্যানেল রয়েছে। চার্চের দেয়ালে খ্রিস্ট এবং তার রূপান্তরণের বেশ কয়েকটি চিত্র শোভা পেয়েছে।
- অবস্থান: লাইব্রেরি রোড, কালিঘাট
- ধর্মীয় সম্প্রদায়: গ্রীক অর্থডক্স
- সময়: উল্লেখ নেই
- কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান: কালিঘাট মন্দির, রবীন্দ্র সরোবর
৮. সেন্ট জেমস চার্চ
সেন্ট জেমস গির্জা স্থানীয়ভাবে “জোড়া গির্জা” নামে পরিচিত। নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, এই চার্চের দুটি একইরকম সুউচ্চ মিনার রয়েছে যা কলকাতার আকাশরেখায় আধিপত্য বিস্তার করে। এটি ঔপনিবেশিক যুগের চার্চ, যা ১৮৬২ সালে নির্মিত হয়। চার্চটি নব্য-গথিক স্থাপত্যশৈলীর একটি নিদর্শন।
চার্চের ভেতরে প্রবেশ করলে একটি দীর্ঘ করিডর আপনাকে বিশাল বেদির দিকে নিয়ে যাবে। চার্চের ছাদের ওপরের কালো মহগনি কাঠের কারুকাজ চোখের জন্য বিশেষ আকর্ষণ।
- অবস্থান: আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড, জোড়া গির্জা
- ধর্মীয় সম্প্রদায়: চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়া
- সময়: প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা
- কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান: মার্বেল প্যালেস, কলেজ স্ট্রিট, ইন্ডিয়ান কফি হাউস
৯. সেন্ট তেরেসার গির্জা
কলকাতার মৌলালি অঞ্চলে অবস্থিত সেন্ট তেরেসার গির্জা স্থাপত্য সৌন্দর্যের জন্য খ্যাত। ১৮৮৯ সালে নির্মিত, প্রাণবন্ত তালতলায় অবস্থিত, সেন্ট তেরেসার গির্জা কলকাতার ক্যাথলিক ঐতিহ্যের এক নিদর্শন। বিখ্যাত সাধ্বীর প্রতি উৎসর্গীকৃত, এটি প্রশান্তি এবং আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ করে, ভক্ত এবং দর্শনার্থীদের উভয়কেই আকর্ষণ করে।
বড়দিনের সময় এলে, এই চার্চে মধ্যরাতের প্রার্থনায় যোগ দেওয়ার চেষ্টা করুন। সুন্দরভাবে সজ্জিত এই গির্জা এবং প্রার্থনার পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে।
- অবস্থান: আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড, এন্টালি মার্কেট
- ধর্মীয় সম্প্রদায়: রোমান ক্যাথলিক
- সময়: প্রতিদিন সকাল ৬:০০ থেকে সন্ধ্যা ৬:০০
- কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান: মাদার্স হাউস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ময়দান, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম
কলকাতার চার্চগুলো বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়, স্থাপত্যশৈলী এবং ইতিহাসের প্রতিফলন। এগুলো শহরের সমৃদ্ধ ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে বিভিন্ন খ্রিস্টান সম্প্রদায় ও স্থাপত্য শৈলী একসঙ্গে সহাবস্থান করেছে।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷