ঝাড়খণ্ডের বিখ্যাত মন্দির বা জনপ্রিয় মন্দিরগুলির প্রত্যেকটি সাধারণ মানুষের অসীম আস্থা ও ঐতিহ্যের জন্য প্রসিদ্ধ তাই বেরিয়ে পড়া যাক একটি আধ্যাত্মিক ভ্রমণে।
আপনি কি এমন একটি ছুটির কথা ভাবছেন, যা শুধু দর্শন নয়, মন ও আত্মার তুষ্টিও করে? তাহলে ঝাড়খণ্ড আপনার জন্য সঠিক গন্তব্য হতে পারে। পূর্ব ভারতের এই রাজ্যটি তার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জন্য প্রসিদ্ধ, যা এর বিভিন্ন বিখ্যাত মন্দিরে প্রতিফলিত হয়। ভক্তি, স্থাপত্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বে ভরপুর এই মন্দিরগুলো শুধু দর্শনীয়ই নয়, এগুলো আমাদের নিয়ে যায় এক আধ্যাত্মিক ভ্রমণে।
ঝাড়খণ্ডের বিখ্যাত মন্দির 10 টি মন্দির
1. বৈদ্যনাথ ধাম, দেওঘর
ঝাড়খণ্ডের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধাম। এটি ভারতে অবস্থিত ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের (পবিত্র শিব মন্দির) একটি, যা হিন্দু ভক্তদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী, যার মধ্যে ২২টি ছোট মন্দির অন্তর্ভুক্ত, পাথর ও তামার কাজে মুগ্ধ করে। একটি পুরাণে বলা হয় যে, এখানে রাবণ শিবের কাছ থেকে ‘শিব লিঙ্গ’ লঙ্কায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছিলেন। তবে, শিব তাকে সতর্ক করেন যে লিঙ্গ একবার কোথাও স্থাপিত হলে তা আর সরানো যাবে না। বিষ্ণু রাবণকে প্রতারণা করে তার যাত্রা বিলম্বিত করেন এবং সেই ফলেই এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়। শ্রাবণ মাসে লক্ষ লক্ষ ভক্ত মন্দিরে এসে শিবের আশীর্বাদ গ্রহণ করেন।
দেখার সেরা সময়: | জুলাই থেকে আগস্ট। |
মন্দিরের সময়: | 24 ঘন্টা – প্রতিদিন। |
কীভাবে পৌঁছাবেন: | নিকটতম শহর দেওঘর, সড়কপথে প্রবেশযোগ্য। |
রেলওয়ে স্টেশন: | দেওঘর রেলওয়ে স্টেশন। |
বাস স্টেশন: | নলহাটি বাস স্টেশন। |
বিমানবন্দর: | দেওঘর বিমানবন্দর। |
2. জগন্নাথ মন্দির, রাঁচি
রাঁচির জগন্নাথ মন্দিরটি ১৭শ শতকে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি ওড়িশার পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিরূপ। এই মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী, জটিল খোদাই ও সুউচ্চ চূড়া বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এটি ভগবান জগন্নাথকে উৎসর্গ করা হয়েছে, যিনি কৃষ্ণের একটি রূপ। প্রতিবছর রথযাত্রা উৎসবের সময় মন্দিরটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, যেখানে ভক্তরা দেবতাদের বহনকারী রথের শোভাযাত্রায় অংশ নেয়।
দেখার সেরা সময়: | জুন থেকে জুলাই। |
মন্দিরের সময়: | সকাল 5টা থেকে সন্ধ্যা 6টা। – প্রতিদিন। |
কীভাবে পৌঁছাবেন: | নিকটতম শহর পুনো, সড়কপথে প্রবেশযোগ্য। |
রেলওয়ে স্টেশন: | জয়সিধি রেলওয়ে স্টেশন। |
বাস স্টেশন: | বিরসা চক বাস স্টেশন। |
বিমানবন্দর: | রাঁচি বিমানবন্দর। |
3. পাহাড়ি মন্দির, রাঁচি
রাঁচির সবুজ পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত পাহাড়ি মন্দির ভগবান শিবকে উৎসর্গীকৃত একটি বিখ্যাত তীর্থস্থান। মন্দিরটি তার নির্মল পরিবেশ এবং মনোরম স্থাপত্যশৈলীর জন্য পরিচিত। এখান থেকে রাঁচি শহরের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করা যায়। পাহাড়ি মন্দিরে উঠতে ৪৬৮টি ধাপ পার হতে হয়, যা ভক্তিমূলক যাত্রার একটি অংশ হিসেবে গণ্য হয়। মন্দিরটি একসময় ব্রিটিশদের অধীনে ছিল, এবং স্বাধীনতার পরে এখানে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়, যা এটিকে দেশের প্রথম মন্দিরে পরিণত করেছে যেখানে এই ধরনের অনুষ্ঠান পালন করা হয়।
দেখার সেরা সময়: | জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। |
মন্দিরের সময়: | ভোর 4:30 থেকে রাত 9 টা – প্রতিদিন। |
কীভাবে পৌঁছাবেন: | নিকটতম শহর রাঁচি, সড়কপথে প্রবেশযোগ্য। |
রেলওয়ে স্টেশন: | রাঁচি রেলওয়ে স্টেশন। |
বাস স্টেশন: | রাঁচি বাস স্ট্যান্ড। |
বিমানবন্দর: | রাঁচি বিমানবন্দর। |
আর পড়ুন: ঘাটশিলা ভ্রমণ গাইড – দর্শনীয় স্থান, কিভাবে যাবেন, থাকার জায়গা
4. সূর্য মন্দির, বুন্দু
ঝাড়খণ্ডের এদালহাতু গ্রামে অবস্থিত সূর্য মন্দিরটি স্থাপত্যের দিক থেকে এক বিস্ময়। মন্দিরটি একটি বিশাল রথের আকারে নির্মিত, যা সূর্য দেবতাকে উৎসর্গীকৃত। মন্দিরের চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং মন্দিরের নিখুঁত কারুকাজ দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। প্রতি বছর এখানে সূর্য মন্দির মেলা অনুষ্ঠিত হয়, যা ঝাড়খণ্ডের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনন্য উদযাপন। এই মেলা দূর-দূরান্ত থেকে বহু ভক্তকে আকর্ষণ করে।
দেখার সেরা সময়: | অক্টোবর থেকে মার্চ। |
মন্দিরের সময়: | সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৫টা। – প্রতিদিন। |
কীভাবে পৌঁছাবেন: | নিকটতম শহর দেওঘর, সড়কপথে প্রবেশযোগ্য। |
রেলওয়ে স্টেশন: | রাঁচি জংশন রেলওয়ে স্টেশন। |
বাস স্টেশন: | বিরসা বাস স্ট্যান্ড। |
বিমানবন্দর: | রাঁচি বিমানবন্দর। |
5. ছিন্নমস্তা মন্দির – রাঁচি
হিন্দু পুরাণ এবং ধর্মীয় বইয়ে ছিন্নমস্তা মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। রাঁচি থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে দামোদর ও ভৈরভি নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত এই মন্দিরটি মাতা ছিন্নমস্তাকে উৎসর্গ করা হয়েছে, যিনি প্রচণ্ড চন্ডিকা নামেও পরিচিত।
দেখার সেরা সময়: | অক্টোবর থেকে মার্চ। |
মন্দিরের সময়: | সকাল ৮টা থেকে রাত ৯:৪০। – প্রতিদিন। |
কীভাবে পৌঁছাবেন: | নিকটতম শহর রাজরাপাই, সড়কপথে |
রেলওয়ে স্টেশন: | বিরসা মুন্ডা রেলওয়ে স্টেশন। |
বাস স্টেশন: | রাজরাপ্পা বাস স্টেশন। |
বিমানবন্দর: | কিশানগড় বিমানবন্দর। |
6. দেউড়ি মন্দির, তামার
রাঁচি থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে তামারে অবস্থিত দেউড়ি মন্দিরটি দেবী দুর্গাকে উৎসর্গীকৃত একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরটিতে ১৬টি হাতবিশিষ্ট ৭০০ বছরের পুরোনো দেবীর মূর্তি রয়েছে। জামশেদপুরের দিকে যাত্রার সময় ভক্তরা এই মন্দির দর্শন করতে পারেন।
দেখার সেরা সময়: | নভেম্বর থেকে এপ্রিল। |
মন্দিরের সময়: | সকাল 5 টা থেকে 8 টা – প্রতিদিন। |
কীভাবে পৌঁছাবেন: | নিকটতম শহর হল তামার, সড়কপথে প্রবেশযোগ্য। |
রেলওয়ে স্টেশন: | রাঁচি রেলওয়ে স্টেশন। |
বাস স্টেশন: | কাটাটুলি বাস স্ট্যান্ড। |
বিমানবন্দর: | রাঁচি বিমানবন্দর। |
আর পড়ুন: রাঁচি ভ্রমণের জন্য সেরা ১২টি দর্শনীয় স্থান
7. বিন্দুধাম মন্দির – সাহেবগঞ্জ
বিন্দুধাম মন্দির স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছে তীর্থস্থান হিসাবে অত্যন্ত সম্মানিত। এই মন্দিরটি দেবী লক্ষ্মী, দেবী দুর্গা এবং দেবী সরস্বতীকে উতসর্গ কোরা হয়েছে । এই বিন্দুধাম মন্দির’এর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যা হাজার হাজার বছর আগের, তবুও এর সঠিক শিকড় এখনও আবিষ্কার করা দরকার।
দেখার সেরা সময়: | মার্চ থেকে এপ্রিল। |
মন্দিরের সময়: | 24 ঘন্টা – প্রতিদিন। |
কীভাবে পৌঁছাবেন: | নিকটতম শহর দেওঘর, সড়কপথে প্রবেশযোগ্য। |
রেলওয়ে স্টেশন: | বারহারওয়া রেলওয়ে স্টেশন। |
বাস স্টেশন: | বুন্দু বাস স্টেশন। |
বিমানবন্দর: | দেওগড় বিমানবন্দর। |
8. কালিকা মহারানী মন্দির – বোকারো
শ্রী শ্রী কালিকা মহারাণী মন্দির ভয়ঙ্কর দেবী কালীর প্রতি একটি মহৎ শ্রদ্ধাঞ্জলি। এর স্থাপত্য, যা বহু বছর ধরে যত্ন সহকারে তৈরি করা হয়েছে, দর্শনার্থীদের ঐশ্বরিক মেয়েলি শক্তির গভীরতা অন্বেষণ করতে আমন্ত্রণ জানায়।
দেখার সেরা সময়: | সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। |
মন্দিরের সময়: | সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা – প্রতিদিন। |
কীভাবে পৌঁছাবেন: | সালসেট তালুকের ভার্নার কাছে, রাস্তা দ্বারা প্রবেশযোগ্য। |
রেলওয়ে স্টেশন: | চাস রেলওয়ে স্টেশন। |
বাস স্টেশন: | সেক্টর 2 বাস স্টেশন। |
বিমানবন্দর: | বোকারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। |
আরও পড়ুন: চলুন নেতারহাট, সঙ্গে বেতলা, লোধ ফলস সহ সমস্ত দর্শনীয় স্থানের খবর
9. হরিহর ধাম মন্দির – বাগোদর
ঝাড়খণ্ডের একটি মন্দির, হরিহর ধাম, 65 ফুট লম্বা বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা শিবলিঙ্গ দিয়ে ভগবান শিবকে সম্মান করে। শিল্পের এই বিশাল কাজটি সম্পূর্ণ হতে ত্রিশ বছর সময় লেগেছিল, যা উত্সর্গের প্রমাণ।
দেখার সেরা সময়: | নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর। |
মন্দিরের সময়: | সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা। – প্রতিদিন। |
কীভাবে পৌঁছাবেন: | নিকটতম শহর হাজারীবাগ, সড়কপথে প্রবেশযোগ্য। |
রেলওয়ে স্টেশন: | বাগোদর রেলওয়ে স্টেশন। |
বাস স্টেশন: | বাস স্টেশন। |
বিমানবন্দর: | বিরসা মুণ্ডা বিমানবন্দর। |
10. নওলাখা মন্দির – দেওঘর
রাঁচির নওলাখা মন্দিরটি স্থাপত্যের মহিমা এবং যুগহীন ভক্তির গল্প বলে বিস্ময়ের নিরন্তর প্রতিধ্বনির মতো উঠে। এর প্রাচীন উৎপত্তির ইঙ্গিত পাওয়া যায় এর নামের দ্বারা, “নৌলখা”, একটি সৃষ্টি যা যুগে যুগে প্রতিধ্বনিত হয়।
দেখার সেরা সময়: | অক্টোবর থেকে মার্চ। |
মন্দিরের সময়: | সকাল 2 টা থেকে সন্ধ্যা 7 টা সোমবার থেকে শনিবার। |
কীভাবে পৌঁছাবেন: | নিকটতম শহর দেওঘর, সড়কপথে প্রবেশযোগ্য। |
রেলওয়ে স্টেশন: | দেওঘর রেলওয়ে স্টেশন। |
বাস স্টেশন: | দেওঘর বাস স্ট্যান্ড। |
বিমানবন্দর: | রাঁচি বিমানবন্দর। |
ঝাড়খণ্ডের মন্দিরগুলি আধ্যাত্মিকতা, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং সৃজনশীল উজ্জ্বলতার একেকটি উজ্জ্বল উদাহরণ। প্রতিটি মন্দিরই উত্সর্গ, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসের গল্প বলে যা রাজ্যের জনসংখ্যার আধ্যাত্মিক বিকাশের অন্তর্দৃষ্টি দেয়। এই পবিত্র এলাকায় প্রবেশ করার পরে ঝাড়খণ্ডের আধ্যাত্মিক ভূখণ্ডের বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধার সমৃদ্ধ আবরণে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন হয়ে যান ।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷