বিষ্ণুপুর ভ্রমন মানেই সবার আগে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে বেশকিছু টেরাকোটা মন্দির। বাঁকুড়া জেলার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ, বিস্ময়কর পোড়ামাটির মন্দিরের জন্য বিখ্যাত বিষ্ণুপুর শহর। বিষ্ণুপুর যেন একটি লুকানো রত্ন যা আমাদের প্রত্যেকের আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে। এই শহরে পা রাখতেই সময়ের সাথে পিছিয়ে যাওয়ার মতো মনে হয়, কারণ এর চমৎকার স্থাপত্য এবং ঐতিহাসিক তাত্পর্য দর্শনার্থীদের একটি পুরান সময়ে নিয়ে যায়। আসুন, মনেমনে একটি ভার্চুয়াল যাত্রায় আমার সাথে, আমরা বিষ্ণুপুরের আকর্ষণে সাড়া দেই এবং এর মনোমুগ্ধকর শিল্প এবং স্থানীয় ঐতিহ্যগুলি বোঝার চেষ্টা করি।
বিষ্ণুপুরের ইতিহাসের এক ঝলক:
বিষ্ণুপুর ইতিহাসের একেবারে উপরে আসে ১৭ শতকে যখন এটি মল্ল রাজবংশের রাজধানী হিসাবে বিকাশ লাভ করেছিল। মল্ল শাসকদের প্রভাব শহরের স্থাপত্যের বিস্ময়, বিশেষ করে পোড়ামাটির মন্দিরগুলিতে স্পষ্ট। এই জটিল নকশা করা মন্দিরগুলি মল্ল কারিগরদের অনন্য কারুকার্য এবং শৈল্পিক প্রতিভা প্রদর্শন করে। রাসমঞ্চ, জোড়বাংলা মন্দির এবং মদনমোহন মন্দিরের স্থাপত্য বিস্ময় সৃষ্টি করা একটি জীবন্ত যাদুঘরে প্রবেশ করার মতো।
পোড়ামাটির মন্দির: ( Terracotta Temples )
বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির মন্দিরগুলি এই শহরে যে কোনও ভ্রমণের বিশেষ আকর্ষণ। বিস্তৃত পোড়ামাটির খোদাই দ্বারা সজ্জিত এই মন্দিরগুলি রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর দৃশ্যগুলিকে ফুটিয়ে তোলে। প্রতিটি মন্দিরের একটা নিজস্ব শৈলী এবং বর্ণনা রয়েছে, যা ইতিহাস উত্সাহীদের এবং শিল্পপ্রেমীদের জন্য একটি চাক্ষুষ ট্রিট প্রদান করে। পোড়ামাটির প্যানেলের জটিল ডিটেলিং / বিবরণ এবং প্রাণবন্ত রং সত্যিই মন্ত্রমুগ্ধ করে এবং এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে।
কারুশিল্প এবং শৈল্পিকতা: ( Craftsmanship and Artistry )
বিষ্ণুপুর শিল্প অনুরাগীদের একটি অত্যন্ত প্রিয় গন্তব্য, এর সমৃদ্ধ শিল্প ও নৈপুণ্য মুগ্ধ করে। শহরটি তার সূক্ষ্ম বালুচরী শাড়ির জন্য বিখ্যাত, যেগুলি পৌরাণিক গল্পগুলিকে চিত্রিত করা জটিল নকশা দিয়ে বোনা হয়। দক্ষ তাঁতিদের দ্বারা এই শাড়ি তৈরির সাক্ষী হওয়া একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। উপরন্তু, অঞ্চলটি তার ডোকরা শিল্প, ধাতব ঢালাইয়ের একটি ঐতিহ্যবাহী রূপ এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিখ্যাত বিষ্ণুপুর ঘরানার জন্য বিখ্যাত। ভ্রমনকারীরা স্থানীয় কারিগর এবং সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে যুক্ত হতে পারেন, তাদের কৌশল এবং তাদের নৈপুণ্য সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পারে।
বিষ্ণুপুরের সঙ্গীত ঐতিহ্য: ( Musical Heritage )
বিষ্ণুপুর ঘরানা, ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে সম্মানিত স্কুলগুলির মধ্যে একটি, এই শহরেই উদ্ভূত হয়েছিল। সঙ্গীতের এই অনন্য শৈলী, যা বিষ্ণুপুর ঘরানা নামেও পরিচিত, লোক সুরের সাথে শাস্ত্রীয় সুর মিশ্রিত করে এবং এর প্রাণবন্ত পরিবেশনা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। বিষ্ণুপুর ঘরানা অনেক কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ তৈরি করেছে যারা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। আচার্য রামশঙ্কর, যদুভট্ট, অনন্ত লাল, রাধিকাপ্রসাদ, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী ইত্যাদি বহু সংগীতের দিকপাল বিষ্ণুপুর ঘরানাকে বিশ্ব দরবারে যুগের পর যুগ সমৃদ্ধ করেছে। সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে পারফরম্যান্স এবং মিথস্ক্রিয়া মাধ্যমে এই সঙ্গীত ঐতিহ্য অন্বেষণ যে কোন সঙ্গীত প্রেমিকের জন্য এক অমুল্য অভিজ্ঞতা।
বিষ্ণুপুরে কি কি দেখবেন।
সত্যিকার অর্থে বিষ্ণুপুরের আকর্ষণে নিজেকে নিমজ্জিত করতে, একটি সাইকেল রিকশায় উঠে বসুন এবং মন্দিরগুলির সাথে সংযোগকারী সরু গলিপথ অতিক্রম করুন৷ ধীর গতির রাইড আপনাকে পোড়ামাটির খোদাইয়ের জটিল বিবরণের প্রশংসা করতে, স্থানীয় পরিবেশে ভিজতে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ করে দেয়। সাইকেল রিক্সা চালকরা প্রায়শই জ্ঞানী গাইড হিসাবে দ্বিগুণ হয়ে যায়, ভ্রমণকারীদের আকর্ষণীয় গল্প এবং ঐতিহাসিক উপাখ্যানের সাথে আমন্ত্রণ জানায়।
বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার বিখ্যাত মন্দিরগুলি হল রাসমঞ্চ, রাধা কৃষ্ণ মন্দির, শ্যাম রায় মন্দির, মদন মোহন মন্দির ইত্যাদি।
রাসমঞ্চ :
১৬০০ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত, বীর হাম্বিরের শাসনকালে এই মঞ্চ বর্তমানে বিষ্ণুপুরের সবথেকে পুরনো স্থাপত্যের নিদর্শন। রাসমঞ্চের স্থাপত্যশৈলী অন্য সকল মন্দিরের থেকে আলাদা। সম্ভবত গোটা ভারতে এই শৈলীর অন্য কোনও নিদর্শন নেই। রাসের সময়, বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন মন্দিরের মূর্তি এই মঞ্চে নিয়ে আসা হয় এবং দর্শকরা ঘুরে দেখতে পারেন।
শ্যামরাই মন্দির :
এই মন্দিরটি পোড়া ইটের তৈরি পঞ্চরত্ন মন্দিরগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধরা হয় । ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ স্থাপন করেন। ইটের তৈরি এই মন্দিরটির ছাদটি চতুর্ভূজাকার বাঁকানো চালা ছাদ আকৃতির এবং পাঁচটি চূড়া বিশিষ্ট । মাঝের চূড়াটি আটটি করিডোর দিয়ে ঘেরা অষ্টভুজ আকৃতির । মন্দিরটির গায়ে টেরাকোটা কাজের সুন্দর নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।
কেষ্টরাই মন্দির বা জোড়বাংলা মন্দির :
টেরাকোটার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল এই কেষ্টরাই মন্দির বা জোড়বাংলা মন্দির। এই শৈলীতে মন্দিরের দুটি ভাগ পাশাপাশি অবস্থিত এবং প্রায় একইরকম দেখতে। মন্দিরে জোড়ার দেওয়ালগুলোতে রামায়ণ মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্যগুলি দেখা যায়।
রাধাশ্যাম মন্দির :
১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ দ্বারা স্থাপিত বর্গাকৃতি দক্ষিণমুখী মাকরা পাথর দ্বারা নির্মিত গম্বুজাকৃতি এক শিখর বা একরত্ন মন্দির । মন্দিরটি প্রাচীর বেষ্টিত ও প্রশস্ত অঙ্গনের ভিতরে অবস্থিত । মন্দিরের গায়ে আঁকা ভাস্কর্যে কিছুটা পঙ্খের আবরণ বর্তমান রয়েছে এখনো। পাশের ভগ্নপ্রায় মন্দির থেকে বিগ্রহ তুলে এনে এই মন্দিরে রাখা হয়েছে । এখনো নিয়মিত পূজার্চনা হয় ।
গড় দরজা :
বিষ্ণুপুরের দুর্গের দুইটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। স্থানীয় লোকেরা তাদেরকে ‘গড় দরজা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ‘মুরচা’ পাহাড়ের পাশে পাথরের তৈরি একটি ছোট ঢিবি আছে। ছোট গেটটি অতিক্রম করার পরে একটি বিশাল গেট আছে যেটি ছিল বিষ্ণুপুর রাজত্বের প্রবেশদ্বার। ‘গড় দরজা’ শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এটির একটি বিশাল ছাদ এবং গোপন কক্ষ রয়েছে। সৈনিকরা ‘গড়’ থেকে অনধিকার প্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে রাখত এবং তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করত।
মদনমোহন মন্দির :
বিষ্ণুপুরের এই ‘বিষ্ণু’ মন্দিরটি অবশ্যই দেখবেন। মন্দিরটি এখানকার মধ্যে সেরা পোড়ামাটির শিল্পের নিদর্শন বহনকারী অন্যতম প্রধান কাঠামোগত রূপ। মল্ল রাজা দুর্জন সিংহ দেব ১৬৯৪ সালে ভগবান মদন মোহন-এর নামে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি আজ অবধি এখানে পূজা অর্চনা হয়।
দলমাদল :
দলমাদল একটি কামান যা মল্লভূমের গর্বের প্রতীক। কামানটির দৈর্ঘ ১২ ফুট ৫ ইঞ্চি ও পরিধি ১১ ইঞ্চি এবং গঠনগত দিকথেকে মধ্যযুগের ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ কয়েকটি কামানের অন্যতম। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সালের সময়কালে মারাঠা ভাস্কর পণ্ডিতের বর্গিবাহিনী বাংলায় ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে বিষ্ণুপুর সহ সমগ্র বাংলাকে মন্দার মুখে ঠেলে দিয়েছিল। শেষবারের প্রতিরোধের সময় হতাশ রাজা হাল ছেড়ে দিয়ে নগরদেবতা মদনমোহনের শরণ নিলেন। ভক্তের ভগবান স্বয়ং দলমাদলে অগ্নিসংযোগ করে বর্গি বিতাড়ন করেন বলে স্থানীয় মানুষজন বিশ্বাস করেন এবং এভাবেই এই মহা-শক্তিশালী কামানের নাম “দলমাদল” অর্থাৎ শত্রুবিনাশক হয়।
বিষ্ণুপুর ভ্রমণের সেরা সময়।
আপনি বছরের যে কোন সময় বিষ্ণুপুর আসতে পারেন । কিন্তূ বিষ্ণুপুর আসবার সেরা সময় হলো শীত কাল ও তার শেষের দিকে ( নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ) কারণ বিষ্ণুপুরের আবহাওয়া হলো তুলনামূলক অন্য এলাকার থেকে একটু গরম বেশি হয় । বাঁকুড়া জেলার উচ্চ তাপ মাত্রার জন্য গরম কালে না আসাই ভাল এছাড়া বিষ্ণুপুরে শীতে ২৩ থেকে ২৭শে ডিসেম্বরের বিষ্ণুপুর মেলা ও ডিসেম্বরের ২৩ থেকে ২৯ তারিখ বিষ্ণুপুরে সবলা মেলা হয় যা আপনি দেখে নিতে পারবেন ।এছাড়া প্রতি শনিবার বিষ্ণুপুরে পোড়ামাটির হাট বসে যেখানে আপনি অনেক মাটির তৈরি অসাধারণ সব জিনিশপত্র পাওয়া যায় ।
কিভাবে যাবেন বিষ্ণুপুর :
বাস : কলকাতা থেকে সহজেই বাস ধরে বিষ্ণুপুর আসা যায়। ধর্মতলা থেকে সরাসরি সরকারি ও বেসরকারি বাস আপনাকে বিষ্ণুপুর পৌঁছে দেবে।
ট্রেন : ট্রেনে হাওড়া থেকে পুরুলিয়া এক্সপ্রেস, শিরোমনি এক্সপ্রেস ধরে সহজেই বিষ্ণুপুর আসা যায়, এছাড়া আপনি সাঁতরাগাছি থেকে পেয়ে যাবেন আরন্যক এক্সপ্রেস কিংবা রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস যা সহজেই আপনাকে পৌঁছে দিবে বিষ্ণুপুর শহরে ।
বিষ্ণুপুর অঞ্চলের বা বাঁকুড়ার ম্যাপ সুবিধার্থে দেখতে পারেন।
বিষ্ণুপুর কোথায় থাকবেন বা খাবেন :
এখানে আপনি এসে সহজেই পেয়ে যাবেন ভালো হোটেল পেয়ে যাবেন। এছাড়া প্রচুর মধ্যম বাজেটের হোটেলও পেয়ে যাবেন । সহজেই আপনি পেয়ে যাবেন সোনার বাংলা লজ, উদয়ন লজ , হোটেল লক্ষ্মী পার্ক , হোটেল অন্নপূর্ণা ইত্যাদি। বিষ্ণুপুরে হোটেল ছাড়াও বেশ কিছু গেস্টহাউস রয়েছে। আপনি কিছু গ্রামে হোমস্টে খুঁজে পেতে পারেন।
বিষ্ণুপুরের ম্যাচা সন্দেশ, প্যাঁড়া এবং পোস্তর বড়া বিখ্যাত, এবং সুযোগ পেলে অবশ্যই খেয়ে দেখবেন।
আরও পড়ুনঃ গুপ্তিপাড়া – বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বহনকারী এক জনপদ
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷
বিষ্ণুপুর সম্পর্কে লিখলেন আর দলমাদল কামানের উল্লেখ নেই। এটা অসম্পূর্ণ বিবরণ।
রনবীর বাবু,
আপনার সুচিন্তিত মতামতের জন্য ধন্যবাদ।
দলমাদল কামান সম্পর্কিত সংযোজন করা হল।