গুপ্তিপাড়া হল হুগলী জেলার উত্তর-পুর্ব প্রান্তে, হাওড়া-কাটোয়া লোকালে হুগলী জেলার শেষ স্টেশন, পরের স্টেশন অম্বিকা-কালনা (পুর্ব বর্ধমান)। এখান থেকে নদীয়া জেলাও খুব কাছে। গুপ্তিপাড়ার প্রাচীনত্ব বাংলার সংস্কৃতিতে এই স্থানের অবদান একরকম কিংবদন্তী। শিক্ষা, শাস্ত্র, বিদ্যাচর্চা, গ্রন্থ রচনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে এক সময় এটি সমগ্র বাঙলার মধ্যে উজ্জ্বল স্থান দখল করে ছিল। এই জনপদটি মধ্যযুগীয় বাংলায় সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত হয়েছিল। এমনকি ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে প্রায় ১০০ টি টোল ছিল। বহু পুরানো ইতিহাস সাক্ষ্য আজও বহন করে চলেছে এই জায়গাটি । ইতিহাস থেকে জানা যায় এই জায়গাটির নামকরন গোপতিপাড়া বা গুপ্তিপাড়া মতান্তরে গুপ্তোপল্লী থেকে গুপ্তিপাড়া।
কিভাবে যাবেন গুপ্তিপাড়া?
ট্রেনে – কলকাতা থেকে গেলে সব থেকে ভাল উপায় হল লোকাল ট্রেন। হাওড়া থেকে কাটোয়া লাইনের ট্রেন ধরে সোজা গুপ্তিপাড়া স্টেশন। একদম স্টেশন চত্তর থেকেই রিক্সা বা টোটো নিয়ে দশ মিনিটে পৌঁছে যেতে পারেন গুপ্তিপাড়া মঠে। এখানকার সবগুলি দেখার জায়গাই ওই ২ কিলোমিটারের মধ্যেই আছে।
সড়কপথে –
১। এয়ারপোর্ট থেকে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সোজা কল্যাণী। সেখান থেকে ঈশ্বর গুপ্ত সেতু দিয়ে গঙ্গা ওপারে বাঁশবেড়িয়ার ঝুলনিয়া মোড় থেকে ৬নং স্টেট হাইওয়ে দিয়ে জিরাট মোড় তারপর বেহুলা থেকে ডানদিকে ছোট রাস্তা নিন আর পৌঁছে যাবন গুপ্তিপাড়া।
২। বালি থেকে দিল্লী রোড দিয়ে ( অথবা জি টি রোড হয়ে ) চলুন মগরা। সেখান থেকে ৬নং স্টেট হাইওয়ে দিয়ে জিরাট মোড়, তারপর বেহুলা থেকে ডানদিকে ছোট রাস্তা নিলেই পৌঁছে যাবেন গুপ্তিপাড়া।
এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলি
দেশকালীমাতার মন্দির
স্টেশন থেকে রিকশায় বা পায়ে হেঁটে বড়বাজার এলাকা পার হয়েই দেশকালীমাতার মন্দির। প্রতি বছর কালী পুজার দিন মাটির মূর্তি এনে পূজা করা হয়। পুজোর পরের শুক্লা দ্বিতীয়ার দিন ওই মূর্তির কেশ, কাঁকন, কেউর, কপোল প্রভৃতি কাটাকুটি করে বাকি মূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। কাটা অংশগুলি একটি পাত্রে রেখে সারাবছর তান্ত্রিক মতে নিত্যপূজা করা হয়। দেশকালীমাতাই গুপ্তিপাড়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী বলে পূজিতা।
গুপ্তিপাড়া মঠ
গুপ্তিপাড়ার গঙ্গার ধারে এই চত্বরে চারটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে, এই চারটি মন্দিরকে একসাথে ‘গুপ্তিপাড়ার মঠ’ বলা হয়। এই মন্দিরগুলি হল শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির, শ্রী চৈতন্যদেবের মন্দির, শ্রী রামচন্দ্র মন্দির এবং শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির। মঠের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হল শ্রী রামচন্দ্র মন্দির। সুন্দর পোড়ামাটির কাজের জন্য যেটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ টেরাকোটার মন্দির হিসাবে গন্য। মঠের মধ্যে সবচেয়ে বড় হল শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির কিন্তু মঠ চত্বরে অবস্থিত মন্দিরগুলির মধ্যে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর মন্দিরটি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন।
শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির :
গুপ্তিপাড়া মঠের মধ্যে এই মন্দিরটিই সবচেয়ে বড় ও প্রসিদ্ধ। আটচালা শৈলীর এই মন্দিরটি সম্পূর্ণ ইটের তৈরী। মন্দিরটির গঠনের নকশাটি সবাইকে মুগ্ধ করে। মন্দিরটির বাইরের দিকে খুব বেশি পোড়ামাটির ভাস্কর্য নেই। বেশ উঁচু একটি ওপর মূল মন্দিরটি রয়েছে। গর্ভগৃহের কাঠের দরজাটিতেও সুন্দর কাজ করা আছে। মন্দিরটিতে রাধাকৃষ্ণের মুর্তি অধিষ্ঠিত আছে। আদি মন্দিরটি ভেঙ্গে যাওয়ার পর এই নতুন মন্দিরটি বাগবাজারের জমিদার শ্রী গঙ্গানারায়ণ সরকার মহাশয় তৈরী করে দিয়েছিলেন।
শ্রী রামচন্দ্র মন্দির :
এই মন্দিরের গায়ের সুন্দর পোড়ামাটির কাজের জন্য যেটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ টেরাকোটার মন্দির হিসাবে গন্য। মন্দিরটি একচূড়া বিশিষ্ট চারচালা শৈলীতে তৈরী। বুক সমান উঁচু বেদির ওপর মন্দিরটির অবস্থান। এখানে শ্রীরামচন্দ্র, সীতামাতা এবং লক্ষ্মণের ও বামপাশে করজোড়ে মহাবীর হনুমানের বিগ্রহ প্রতিমা রয়েছে। এই মন্দিরের কারুকাজের মতো কাজ বিষ্ণুপুর ছাড়া আর কোথাও কোনো মন্দিরে দেখা যায় না।
শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির :
এই মন্দিরটিও তিনটি খিলান বিশিষ্ট আটচালা মন্দির। মুল মন্দিরের কার্নিশের নীচে, তিন খিলানের পার্শ্ববর্তী দেওয়ালে ও থামের উপর অবশিষ্ট সামান্য কিছু কারুকার্য গৌরবান্বিত অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে। মন্দিরটি অন্যান্য মন্দিরের মতো উঁচু বেদির উপর স্থাপিত। এখানে রাধাকৃষ্ণ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র ও শ্রীরাধিকার বিগ্রহ রয়েছে গর্ভগৃহে। দন্ডি মধুসূদন ১৭৪৫ সালে মন্দিরটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।
শ্রী চৈতন্যদেবের মন্দির :
এই মন্দিরটি ১৭০০ সালে তৈরী হয়েছিল। বৃন্দাবনচন্দ্র মঠ চত্বরে অবস্থিত মন্দিরগুলির মধ্যে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর মন্দিরটি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। বাংলার জোড়বাংলা রীতিতে নির্মিত উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত। প্রাচীনত্বের ভার এবং অপটু সংস্কারের ফলস্বরূপ অধিকাংশ টেরাকোটার কাজই আজ হারিয়ে গেছে। অল্প কিছু কাজ প্রবেশপথের উপরের দিকে দেখতে পাওয়া যায়। শ্রী চৈতন্যদেব ও শ্রী নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর কাঠের মুর্তি বর্তমান।
গুপ্তিপাড়া সেন বাড়ি
এখানকার হাটখোলা কাছেই কিছুটা হেঁটে গেলেই চোখে পড়বে ‘সেন’ বাড়ি। এই সেনবাড়ি সম্পর্কে যতটুকু জানাযায় তা এই রকম ” প্রায় ৪০০ বছর আগে এই বাড়িটি তৈরি করান ‘কির্ত্তি’ সেন। এই কির্ত্তি সেন, বাংলার রাজা লক্ষন সেনেরই পরবর্তি প্রজন্মের একজন ছিলেন।” সেনবাড়ির বাইরের চত্বরে দুটি শিব মন্দির আছে আর সেন বাড়ী ঢোকার মুখেই বিশাল চাতাল চোখে পড়ার মত। শোনাযায় ওই চাতাল ঘিরে যে ঘরগুলি আছে তাতে নাকি সেযুগে, তাদের চাকরবাকর দের থাকার ব্যবস্থা ছিল। এখানে প্রতি বছর বেশ জাঁক-জমক করেই দুর্গাপুজো হয় তবে একটা বিশেষত্ব আছে, এই দুর্গাপুজোর লক্ষ্মী ঠাকুরের পেঁচার মুর্তি থাকে না। তার বদলে এই বাড়িতেই খাঁচাতে জ্যান্ত পেঁচা পোষা থাকে এবং ওই জ্যান্ত পেচাকেই পুজো করা হয় লক্ষ্মী ঠাকুরের বাহন হিসাবে।
গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা
বাংলার প্রসিদ্ধ রথযাত্রা গুলোর মধ্যে অন্যতম এই গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা। সারা বছর জগন্নাথ দেব বৃন্দাবন জিউ মন্দিরে থাকেন। রথযাত্রায় মাসির বাড়ি যান।বেলা বারোটায় হবে রথের প্রথম টান। জানা যায় ১৭৪০ সালে এই রথ উৎসব শুরু করেন মধূসুদানন্দ মতান্তরে পিতাম্বরানন্দ।গুপ্তিপাড়ার রথ বৃন্দাবন জিউ রথ। তবে রথযাত্রা উপলক্ষে গুপ্তিপাড়া রথের যাত্রা পথের ধারে যে মেলা বসে তা প্রায় একমাসের কাছাকাছি সময় ধরে চলে। আর এই সমস্ত জমিই বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরের সম্পত্তি বলে শোনা যায়। মেলায় দোকান দেওয়ার জন্য নিলাম ডাকা হয় এবং এই মেলা থেকে প্রাপ্ত আয় বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির তথা গুপ্তিপাড়া মঠের অন্যতম চালিকা শক্তি।
গুপ্তিপাড়া ভান্ডার লুট
গুপ্তিপাড়া রথযাত্রা উতসবের একটি বড় আকর্ষন হল ভান্ডার লূঠ । উল্টো রথের ঠিক আগের দিন। এই ভান্ডারলুঠ উৎসবটি আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনে গোপ বাড়িতে বেড়ে ওঠার স্মৃতি যেন স্মরণ করি। ভান্ডার লুঠ যেদিন হয় সেদিন বিকেলে নানা বাঞ্জনে, ক্ষীর, দই ও নানান মিষ্টান্ন সহ শ্রীশ্রী জাগন্নাথ দেবকে ভোগ দেওয়া হয়। ভোগ পর্ব শেষ হওয়া মাত্রই পুরোহিত মশাই মন্দিরের দরজা খুলে দেন। আর তখনই সমস্ত ভক্তবৃন্দ ওই ভোগ কাড়াকাড়ি করে লুঠ করে নেন। এই ‘লুঠ’ করার ঘটনাটা আসলে, আমার মনে হয়, ভগবানের কৃপা লাভের জন্যও যে লড়াই করেই নিতে হয় সেই মানসিকতা স্মরণ করায়।
কিছু টুকরো ইতিহাস
- ষোড়শ শতকের শেষ দিকে সম্রাট আকবরের সময়কালে জগৎগুরু শঙ্করাচার্যের শিষ্য সত্যদেব স্বরসতী গুপ্তিপাড়াতে বৃন্দাবন চন্দ্রের ( শ্রী বিষ্ণু ) একটি মন্দির স্থাপন করেছিলেন। মনে করা হয় ‘কালাপাহাড়’ নামে এক মুসলিম সেনাপতির আক্রমনে সময় শ্রী বৃন্দাবন চন্দ্রের মূর্তিটি একটি ফ্রেস্কো চিত্রের আড়ালে মন্দিরের গোপন সিলিং এর মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে এই গুপ্ত বা লুকানো কথা থেকেই এই জায়গার নাম হয়তো গুপ্তিপাড়া।
- আজ যে বারোয়ারি পুজোর এত রমরমা, তার প্রথম প্রচলন হয়েছিল গুপ্তিপাড়াতে। আনুমানিক ১৭৮৯-৯০ সাল নাগাদ বিন্ধ্যবাসিনীদেবীর পুজো উপলক্ষ্যে।১২ জন বন্ধু মিলে ওই পুজো বজায় রাখেন। সেই ১২ জন বন্ধু বা ইয়ার থেকেই বারো ইয়ারি বা বারোয়ারি পুজোর প্রচলন। কী রকম?
- গুপ্তিপাড়া মঠের অভিনবত্ব হলো একটি বৈষ্ণব মন্দিরের সমষ্টি হওয়া সত্ত্বেও এর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন দশনামী শৈব সন্ন্যাসীগণ।
প্রতীক দত্তগুপ্ত, থাকেন কলকাতায়, কাজ বাদে বেড়ানোই যার প্রথম ভালবাসা। এই কয়েক বছর হল বেড়ানোর সাথে কলমও ধরেছেন । তিনি শুধুমাত্র যে জায়গাগুলি পরিদর্শন করেছেন সেগুলি সম্পর্কেই ব্লগ করেন না, তবে তিনি তার অনুগামীদের জন্য টিপস, কৌশল এবং নির্দেশিকাগুলি সম্পর্কেও পোস্ট করেন৷